অন্তর্বর্তী সরকারের ওয়াদা পূরণের উপায় কী

অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

পালিয়ে থাকা আওয়ামী দোসরেরা এখনো বলেই চলেছে, ইউনূস সরকার অনির্বাচিত ও অবৈধ এবং তাদের এমনকি সামনের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করারও এখতিয়ার নাকি নেই।

অন্যদিকে একজন বুদ্ধিজীবী এবং আন্দোলনকারীদের ‘রক্ত গরম’ অংশের অনেকেই বলছেন, বিপ্লব যেহেতু হয়েছে, এই সরকার যেহেতু সামষ্টিক জন-অভিপ্রায়ের ফসল, সেহেতু এখনকার সরকার শুধু বৈধ নয়, বরং তাদের ওপর দায়িত্ব হচ্ছে আগের সবকিছু ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান দিয়ে দেশটাকে নতুন করে গড়ে তোলা।

আমাদের অভিজ্ঞতা অবশ্য দেখাচ্ছে, এই সরকার নিজেই মনে করছে না যে সে সবকিছু ফেলে দিতে পারে; না শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিদেশি সংস্থা ও ব্যবসায়ীরা সেই দুর্বলতা টের পেয়ে সামনের নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত কোনো চুক্তিতেই শামিল হচ্ছে না।

তার মানে তারাও জানে, চুক্তি সই করার সাফকবলা বৈধতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। আর এই সরকার এমনকি যখন তার নিজের তৈরি করা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো পাচ্ছে, তখন বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টা তারা আর করছে না; পরবর্তী সরকারের জন্য সেগুলো তুলে রাখছে। তার মানে, তারা নিজেরাই মনে করছে সংস্কার করার বৈধতা তাদের নেই।

আরও পড়ুন

হাসিনা যখন পালালেন, তখন সেনাপ্রধান ওয়াকার সাহেব পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব নেওয়ায় দেশের মানুষ খুশি হয়েছিল; কারণ, রাষ্ট্রীয় শক্তির কেন্দ্রে শূন্যতা দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে। তারপর প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পৌরোহিত্যে ইউনূস সাহেব যখন হাল ধরলেন, তখন দেশের মানুষ একটা বৈধ বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতায় দেখে স্বস্তি পেয়েছিল।

এই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা এসেছিল বিদ্যমান সংবিধানের ধারাবাহিকতার বলেই। কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও ইউনূস সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার বৈধতা এসেছিল অভ্যুত্থান থেকেই। আর অভ্যুত্থান যেহেতু শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে হয়নি, ইউনূস সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর বৈধতা এসেছে স্বৈরাচার যাতে আর ফিরে না আসতে পারে, সেই দায়িত্বপ্রাপ্তি থেকে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হলো, এই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার শক্তির সীমা কতটুকু? যেহেতু বিদ্যমান সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই অন্তর্বর্তী সরকারের সৃষ্টি, সংবিধানকে পরিবর্তন করার অধিকার তাদের নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো আইনসভা বা সংসদ নেই বলে আইন তৈরি করার এখতিয়ারও তাদের নেই। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু দেশের নির্বাহী প্রধান, সেহেতু ডিক্রি জারি করার অধিকার তাদের আছে।

প্রশ্ন হলো, ডিক্রি জারি করে কি স্বৈরাচার ফিরে না আসার প্রয়োজনীয় সংস্কার তারা করতে পারবে? উত্তর হচ্ছে—না, সংবিধান এবং আইনের সংস্কার ছাড়া স্বৈরাচার ফিরে আসা তারা ঠেকাতে পারবে না।

আইন পরিবর্তন করার জন্য লাগে একটা সংসদ। এই সরকারের নির্বাচিত সংসদ নেই বিধায় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত সংসদ দিয়ে প্রয়োজনীয় আইন করার চেষ্টা তারা করতে পারে। কিন্তু স্বৈরাচার ঠেকাতে শুধু আইন পরিবর্তন করে কাজ হবে না, প্রয়োজন পড়বে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার করে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।

বিদ্যমান সংবিধানের বলেই সংসদ সদস্যরা শপথ নেন, ফলে সেই সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করার এখতিয়ার তাঁদের থাকে না। তাঁদের দৌড় সংশোধন পর্যন্ত। সংবিধানের মৌলিক সংস্কার করতে পারে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের পরিষদ, যেটাকে বলা হয় কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ।

আরও পড়ুন

নতুন করে সংবিধান লিখছে না বলে আমরা এই পরিষদকে সংবিধান সংস্কার পরিষদও বলতে পারি। গণপরিষদের নির্বাচনটাই হয় নতুন সংবিধান তৈরির জন্য বা বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য।

তার মানে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি নির্বাচন দিলে তার ওয়াদা পূরণ হচ্ছে না কিন্তু সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদের নির্বাচন দিলে তার দায়িত্ব পূরণের পথ তৈরি হয়।

সমস্যা থেকে যাচ্ছে যে শুধু গণপরিষদের নির্বাচন দিলেই স্বৈরাচার আসার পথ বন্ধ করা যাবে না; কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদে এসে স্বৈরাচার ঠেকানোকে গুরুত্ব না-ও দিতে পারেন।

এই সমস্যার সমাধান আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাসেই আছে। আইয়ুব খানের পতনের পর পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের ভারসাম্য সাংবিধানিক উপায়ে নিরসন করার প্রয়োজন তীব্র হয়ে ওঠে। সে জন্য ইয়াহিয়া যখন সত্তরের নির্বাচনের ঘোষণা দেন, তখন তিনি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে সেই নির্বাচনে একটা গণপরিষদ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সেই গণপরিষদের লক্ষ্য কী হবে, সেটার রূপরেখা সেই অর্ডারে লেখা ছিল।

এই সনদই হতে পারে এ সময়ের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার। এই সনদের ভিত্তিতে তৈরি গণপরিষদ, জুলাই সনদে বেঁধে দেওয়া সব কটি সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে বাধ্য থাকবে। আর সেটা হলেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওয়াদা পূরণ হবে এবং সেই সংস্কৃত সংবিধানের বলে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা সসম্মানে বিদায় নিতে পারবে।

তার মানে এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওয়াদা পূরণের উপায় হচ্ছে, একটা নতুন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার তৈরি করে গণপরিষদের নির্বাচন দেওয়া। সৌভাগ্যবশত ঐক্য কমিশন যে জুলাই সনদ তৈরি করতে যাচ্ছে, সেখানে সব কটি রাজনৈতিক দলের সমঝোতার প্রতিফলন আছে।

এই সনদই হতে পারে এ সময়ের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার। এই সনদের ভিত্তিতে তৈরি গণপরিষদ, জুলাই সনদে বেঁধে দেওয়া সব কটি সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে বাধ্য থাকবে। আর সেটা হলেই এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওয়াদা পূরণ হবে এবং সেই সংস্কৃত সংবিধানের বলে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা সসম্মানে বিদায় নিতে পারবে।

  • সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন-এর একজন কর্মী।

    (মতামত লেখকের নিজস্ব)