বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা কোথায় হারাল

‘ছেলেবেলা হইতে আমরা যে প্রণালিতে যে শিক্ষা পাই, তাহাতে প্রতিদিন দেশের সহিত আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়া ক্রমে দেশের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ ভাব জন্মে। বাল্যকাল হইতে আমাদের জ্ঞান-প্রেম-কল্পনার দ্বারে গোরা সৈন্যের পাহারা বসে—আমাদের প্রকৃতির অন্তঃপুরের মধ্যে স্বদেশলক্ষ্মী প্রবেশ করিতে পান না।’ কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধের।

সংবাদমাধ্যমে খবরে দেখলাম, বৃষ্টিতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা পানিতে অবরুদ্ধ। রিকশা সেখানে যেন কলাগাছের ভেলা। একদিকে প্রাকৃতিক মৎস্যচারণক্ষেত্র কমে গেছে, অন্যদিকে মশার রাজত্ব হয়ে গেছে সর্বব্যাপী। বছরে কত কোটি টাকার মশার কয়েল পোড়ে? সেই কয়েলের আগুনে কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটে? আর ম্যালেরিয়া রোগেইবা কতজন আক্রান্ত হয়? বিশাল হিসাব–নিকাশ।

কিছুদিন আগে নদী কমিশন ঢাকার খালগুলোর অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার এক করুণ চিত্র সেটি। ১১টি সার্কেলের ৬টিতে ৬৫টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে। ধারণা করা যায়, বাকি সার্কেলগুলোতেও একইসংখ্যক আছে। এসব খালই চলাচল, পরিবহন ও পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে ঢাকাকে ৪০০ বছর আগে রাজধানীতে পরিণত করেছিল।

রাজধানীর বেদখল হয়ে যাওয়া খাল ও নালা উদ্ধার, সংরক্ষণ ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চারটি খালের আধুনিকায়নের জন্য ৯৮১ কোটি টাকা ও পাশাপাশি নালা ও খালগুলোর আপাতসংরক্ষণের জন্য দুই সিটি ১৬১ কোটি টাকা চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে। অন্যদিকে, নালা ও খাল সংস্কার নিয়ে ঢাকা ওয়াসার চলমান দুটি প্রকল্পের পরিকল্পনাও আছে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)।

গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। এর মাধ্যমে ২৯টি খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে ডিএনসিসি আর ডিএসসিসি পেয়েছে ৫টি। সেগুলোর কী খবর?

‘দেশের কথা’ বইয়ে সখারাম গণেশ দেউস্কর লিখেছেন, ‘গত ১৯০২-০৩ সালের হিসাবে দেখা যায়, রেলের জন্য গবর্নমেন্ট ২৯ কোটি ৮৫ লক্ষ ৭৪.২৫ হাজার টাকা ব্যয় করিয়া ৩০ কোটি ২০ লক্ষ ৮.৫ হাজার টাকা পাইয়াছেন। ঐ সালে জল-পূর্তের জন্য ৩ কোটি ৮৬ লক্ষ ২৮ হাজার ৬৬০ টাকা ব্যয় ও ৪ কোটি ১৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৫০ টাকা আয় হইয়াছে। অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করিয়া কর্তৃপক্ষ রেলে ৩০ লক্ষ ৩৪.২৫ হাজার টাকা লাভ করিয়াছেন; কিন্তু জল-পূর্তে প্রায় পৌণে চারি কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ লক্ষ ৬ হাজার টাকা লভ্য হইয়াছেন।’

রবীন্দ্রনাথের ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধের কথা দিয়ে শেষ করি, ‘যত দিন ভারত-সচিব ও বড়লাটদিগের হস্তে অসীম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, ততদিন এ সকল সংস্কার ঘটিবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কারণ তাঁহারা জনসাধারণের মতামতের প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ করিয়া যথেচ্ছাচার করিয়া থাকেন। ...ভারত শাসনের বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ভিন্ন কোনও পক্ষেরই মঙ্গল নাই। কেবল পার্লামেন্টে ভারতীয় সদস্যদিগকে প্রবেশের অধিকার দান করিলে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া যাইবে না। প্রথমে ভারত-সচিব ও বড়লাটের ক্ষমতার হ্রাস করিতে হইবে।’

সড়ক ও নৌ খাতে গত ১০ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ওয়েবসাইটগুলোয় তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া গেল না। আর রেলপথ নিয়ে গত ১০ মে ডেইলি স্টারের বাংলা সংস্করণে শিরোনাম ছিল ‘লিজ নেওয়া ট্রেনে এক কিলোমিটার যাত্রীপ্রতি খরচ ২.৪৩ টাকা আর আয় ৬২ পয়সা’। ২৪ জুন বণিক বার্তার শিরোনাম ‘১২ বছরে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ: ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ২ টাকা ৭৮ পয়সা ব্যয় করেছে রেল’।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ করেছে ৪৯ হাজার ৬২৬ দশমিক ৯৫ লাখ টাকা আর আয় করেছে ৫০ হাজার ৯১৯ দশমিক ৪১ লাখ টাকা। মুনাফা করেছে  ১ হাজার ২৯২ দশমিক ৯৫ লাখ টাকা। মনে পড়ে, সখারাম গণেশ দেউস্কর তাঁর ‘দেশের কথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ডেনমার্কের জনসংখ্যা ২৫ লক্ষের অধিক নহে। অথচ ড্যানিশ গভর্নমেন্ট এই ক্ষুদ্র জন-সমাজের কৃষি-বিষয়ক উন্নতি সাধনের জন্য ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া থাকেন, আর এই ত্রিংশ (৩০) কোটি জনপূর্ণা ভারত ভূমিতে ১৯ কোটি কৃষিজীবীর মঙ্গলার্থে আমাদের সুসভ্য গবর্মেন্ট বৎসরে দশ লক্ষ টাকার অধিক ব্যয় করিতে পারেন না।’

গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ, মিসরের মতো অনাবৃষ্টির দেশ নয়। এখানে ৫০ থেকে ৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হলেই সব কটি নদীতে বন্যা আসে। উইলিয়াম উইলকক্স তাঁর বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা, বইয়ে লিখেছেন, ‘...বাংলার আদি যুগের কতিপয় রাজা তখন প্লাবন সেচপদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রচলন ঘটান। এটাই শত শত বছরের জন্য বাংলার সম্পদ ও সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। অববাহিকা সেচ যেমন মিসরের জন্য, স্থায়ী সেচ যেমন ব্যাবিলনের জন্য একদম মোক্ষম ছিল; তেমনি বাংলার জন্য উপযুক্ত ছিল এই প্লাবন সেচব্যবস্থা।’

১৯৩০ সালে প্রকাশিত বইটিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘বাংলায় জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারী মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়। এ সময়টা ধান চাষের জন্য আলাদা করে ঠিক করা থাকত। এ ধরনের চাষ নদীর প্লাবন সেচ ছাড়াও চলত, কিন্তু নদীর পানির সংস্পর্শ ছাড়া এই চাষে মাটি অনুর্বর হয়ে যায় এবং ম্যালেরিয়ার জন্ম দিতে পারে। যদিও ম্যালেরিয়ার সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা এর নেই। ধান যখন বৃষ্টির পানিতে দাঁড়িয়ে, তখন নদীতে বান দেখা দিত। কখনো সেই বন্যা হতো বেশি, কখনো কম। বন্যাকে তার মতো থাকতে দিলে কখনো কখনো তা বিপর্যয় সৃষ্টি করত। কখনো এর উপচানো কর্দমাক্ত পানি দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসত, তখন তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে জমিকে পুষ্টি জোগাত এবং ম্যালেরিয়াবাহী মশাকে কিংবা এর সংক্রমণ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঠেকিয়ে দিত। নদীতে বাঁধ দেওয়া এবং নদী থেকে বন্যার পানি বেরোনোর মুখ বন্ধ করে একদম কূল উপচাতে না দেওয়ার অর্থ হলো দেশকে ম্যালেরিয়ার কাছে সঁপে দেওয়া এবং মাটিকে নিঃশেষ করা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়; অতিবন্যা নদীর খাতের মধ্যে আটকে গেলে ভাঙনবিন্দুতে নদীর চাপ এমনভাবে বেড়ে যেত যে আকস্মিক ভাঙনে বিরাট অঞ্চল মারাত্মক ঢল ও বিপর্যয়ের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ত।’

সৌভাগ্যবশত বাংলায় সেচ চলত কেবল বন্যার সময়। তাই কেবল সঠিক পথটি গ্রহণের মাধ্যমেই সহজেই এর পুনর্জীবন সম্ভব। এই কাজে প্রতিবন্ধকতাগুলো আর কিছু নয়, গত ৭০ বছরের ভুল। তারপরও এটা কঠিন কাজ নয়। আমরা জানি কী করতে হবে। প্রাচীনকালের বাঙালিরা যা করত, আমাদের কেবল সেসবই করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের ‘অত্যুক্তি’ প্রবন্ধের কথা দিয়ে শেষ করি, ‘যত দিন ভারত-সচিব ও বড়লাটদিগের হস্তে অসীম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, ততদিন এ সকল সংস্কার ঘটিবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কারণ তাঁহারা জনসাধারণের মতামতের প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ করিয়া যথেচ্ছাচার করিয়া থাকেন। ...ভারত শাসনের বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ভিন্ন কোনও পক্ষেরই মঙ্গল নাই। কেবল পার্লামেন্টে ভারতীয় সদস্যদিগকে প্রবেশের অধিকার দান করিলে বাঞ্ছিত ফল পাওয়া যাইবে না। প্রথমে ভারত-সচিব ও বড়লাটের ক্ষমতার হ্রাস করিতে হইবে।’

আমাদের সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের কথা বলা কি খুব অত্যুক্তি হয়ে যাবে?