গণহত্যায় শহীদ পরিবারগুলো কেন ঘর পাবে না

চিলমারীর মতো আন্তমহাদেশীয় বন্দরে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতটা তুলনামূলক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
ছবি : লেখক

‘কোষ্টার ব্যাপারী তো। থানাহাটত ভোলে চেয়ারম্যানক কোষ্টা বুঝি দিছে। শরীরটা কেমন-কেমন করে বলে বাড়িত আইসছে। এদিকে মিলিটারি আইসছে শুনি জুম্মার ঘরত পলাইছে। পরে হামাক খুঁইজবের নাগি বেলা রানীর বাপ জুম্মার ঘর থাকি যেই বারাইছে, অমনই মিলিটারিরা ডাক দিছে, ওমরা না শুনি দোড় দিছিল। তারপর পাছ (পেছন) থাকি গুলি কইরছে। পিডিত (পিঠে) গুলি ঢুকি বুক দিয়ে বারে গেইছে।...যে জাগাত রক্ত পড়ছিল, পরদিন সেইগলে ঢাইকপের যায়া গুলির খোসাটা পাছনু। দুই বছর আগোত মুক্তিযোদ্ধার ঘরে অফিস রেজ্জাক মুক্তিযোদ্ধাক গুলির খোসাটা দিচং বাবা, ’ বলছিলেন শহীদপত্নী আলেয়া বেওয়া। ভূমিহীন। থাকেন পুঁটিমারীতে পাউবো বাঁধের তলায় অন্যের জমিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুড়িগ্রামের চিলমারীতে গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর সাধারণ ছবি এটাই।

বিধবা বা পিতৃহীন হলে ভবিষ্যৎ তো অন্ধকারই হবে। তাঁদের স্বামী-বাবা-সন্তানেরা বন্দুক হাতে যুদ্ধে শহীদ হননি। তাঁরা বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন কেউ সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, কেউ রাজাকার না হওয়ার কারণে। তাই তাঁরা তালিকাহীন আর করুণাপ্রাপ্ত।

১৯৭১ সাল। পবিত্র রমজান মাসের ৫ তারিখ। চিলমারীর কুখ্যাত রাজারভিটা মাদ্রাসা। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। তারই পাশের পাড়া পুঁটিমারী-হাটিথানা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে এদিন শহীদ হন হাজী কেফাজ উদ্দীন, বাবা: জসিমউদ্দীন মণ্ডল; নেজাবুদ্দীন, বাবা: রহিমুদ্দীন; বেলাল হোসেন বুদে, বাবা: আছর উদ্দীন; ছাত্তার মুন্সি, বাবা: বাছর উদ্দীনসহ প্রায় ৩০ জন। একই দিনে মুদাফৎথানা গ্রামের হোসেন আলী, অজবাল্লি, গাদলা বেগম শহীদ হন, যাঁদের বাবা ও স্বামী যথাক্রমে আরিফ উল্লাহ ও গাদলা। কাজডাঙ্গা ফকিরের হাটের ফয়জার, রব্বানি, আজিত ফরিয়া, যাঁদের বাবা যথাক্রমে নেজাতুল্যাহ, নেফুজা দেওয়ানি ও অজ্ঞাত।

১৯৭৪ সাল। আহমদ ছফা গণভবনের সামনে আত্মহত্যা করবেন। ঢাকা শহর তোলপাড়। কারণ কী! ঘটনা হলো, হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, অথচ শহীদ পরিবার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাদের বাড়িটি দিয়েছিল। তারই প্রতিবাদে আহমদ ছফার আত্মহত্যার উদ্যোগ। উল্লেখ্য, হুমায়ূন আহমেদ-জাফর ইকবালের বাবাও সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা ঢাকা শহরে বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামেগঞ্জের শহীদরা?

এ রকম গণহত্যার শিকার হন চিলমারীর উত্তর রমনা, গুড়াতিপাড়া, টোনগ্রাম, সোনারীপাড়া ও খরখরিয়া গ্রামের অনেকে। উলিপুরের হাতিয়া গণহত্যার কথা তো আমরা জানিই। জানি চিলমারী বন্দরের বধ্যভূমি ও গণকবরের কথা, সামাদ মেম্বারেরচরের নারী ও শিশু হত্যার কথা। বালাবাড়ি রেলস্টেশনের কথা এখনো দগদগে স্মৃতি। লোকজন তো এই সেদিনও সন্ধ্যার পর স্টেশনের রাস্তা দিয়ে হাঁটত না। স্টেশন ভবনের ছাদেও নাকি খুলি ছিল! শহীদদের আত্মারা ঘুরে বেড়ায়! তারা ব্রহ্মপুত্রের বাগাড় মাছের পিঠে চড়ে চরে চরে ঠিকানা খোঁজে।

২.

‘রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত হয়েছে এখানে। অথচ শহীদদের বউ-বাচ্চারা ভিক্ষা করছে! এটা শহীদদের সঙ্গে স্রেফ বেইমানি, ’ ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন চিলমারী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান সরকার। এখন বছর বছর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছেই। এমনকি চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এক রাজাকারকেও পাশের সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নাগরিক দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে। এ ঘটনায় দুই উপজেলাতেই মানববন্ধনসহ নানান কর্মসূচিও পালিত হয়েছে।

আর গণহত্যায় শহীদ মানুষেরা স্মৃতিস্তম্ভে এবং পরিবারগুলো পথে পথে। ইতিহাসে তাঁদের নাম লেখা রবে না। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মানুষেরা দুই প্রকার—শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যায় শিকার শহীদ। শুধু বন্দুক হাতে শহীদ হননি বলেই তাঁর বিধবা স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের আহাজারি মূল্যহীন। কিছু শিশু হয়তো ছিন্ন মুকুলের মাধ্যমে ইউরোপে ঠাঁই পেয়েছে। তাহলে আমরা যে বলি, ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে এই দেশ পেয়েছি, সেই ৩০ লাখের তালিকাই করলাম না। যাঁদের নাম উপজেলা পরিষদের মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, মেম্বাররা জানেন, তাঁদের শুধু শহীদ হওয়ার জন্য একটা ফুল, এক খিলি পান কেউ তুলে দেয়নি। ওই গান লেখা পর্যন্তই!

৩.

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের সরকার বাড়ি ও জমির দলিল দিচ্ছে। চিলমারীর মতো আন্তমহাদেশীয় বন্দরে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতটা তুলনামূলক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। গণহত্যার শিকার হওয়া গ্রামগুলোয় শ খানেক শহীদপত্নী তো আছেনই, যাঁরা আলেয়া বেগমের মতো ভূমিহীন ও বাঁধের রাস্তা থাকেন। যাঁদের চিনপরিচয় আছে, তাঁদের সবার জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্রের ২০ থেকে ২৫টি বাড়ি উপহার দেওয়া যায় কি না। আশ্রয়কেন্দ্রের নামও একটা দেওয়া গেল। মুক্তিযুদ্ধের মতো মহাঘটনার সাক্ষীদের একসঙ্গে পেলাম আমরা।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটি হলে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হতো আশ্রয়কেন্দ্রটি। কিন্তু শহীদপত্নী বা পরিবার হিসেবে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভূমিহীন হিসেবেই তাঁরা বাড়ি পাবেন। অথচ শহীদ পরিবারগুলোর ঠিকানা হতে পারত এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো।’

১৯৭৪ সাল। আহমদ ছফা গণভবনের সামনে আত্মহত্যা করবেন। ঢাকা শহর তোলপাড়। কারণ কী! ঘটনা হলো, হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, অথচ শহীদ পরিবার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাদের বাড়িটি দিয়েছিল। তারই প্রতিবাদে আহমদ ছফার আত্মহত্যার উদ্যোগ। উল্লেখ্য, হুমায়ূন আহমেদ-জাফর ইকবালের বাবাও সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা ঢাকা শহরে বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামেগঞ্জের শহীদরা? তাঁরা অস্ত্র হাতে শহীদ হননি বলে তাঁদের অবহেলা করে দূরে ঠেলে দেব? তাঁদের জন্য কেউ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার ঘোষণা দেবে না বলে?

চিলমারীতে একমাত্র হরিজনপল্লি হলো। সবাই এটাকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু শহীদজায়াদের একটা পল্লি হতে পারত না?

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1 @gmail. com