বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহার, সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ‘মেরিন বায়োলজি’ বিভাগের মাধ্যমে। পরে ১৯৮৩ সালে বিভাগটির কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে এটি ‘ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস’ নামে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হয়। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে, এই ইনস্টিটিউট আধুনিক সমুদ্রশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের গঠন ও গতিপ্রকৃতি, মত্স্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও চাষ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উপকূলীয় জীবনমান–সম্পর্কিত নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে একটি ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স’ হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। তৎসম্পর্কিত জ্ঞান বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ ও সক্ষমতা অর্জনে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা নিম্নে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি
সমুদ্রসম্পদের ধরন, মজুত নিরূপণ, আহরণ, সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বহুমুখী জ্ঞান অর্জন ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগের উদ্দেশ্যে যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন এবং গবেষণার মাধ্যমে এই ইনস্টিটিউট দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে আসছে। অত্র ইনস্টিটিউট ‘মেরিন সায়েন্স’ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি ও সমুদ্রবিজ্ঞান–সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে (মেরিন সায়েন্স, মেরিন ফিশারিজ, অ্যাকুয়াকালচার, সামুদ্রিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ফিশ নিউট্রিশন অ্যান্ড ফিড টেকনোলজি, সি-ফুড টেকনোলজি ইত্যাদি) স্নাতকোত্তর (এমএস, এমফিল, পিএইচডি) ডিগ্রি প্রদান করে থাকে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই ইনস্টিটিউট নানা স্তরের সমুদ্রবিষয়ক জ্ঞানচর্চা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম সহস্রাধিক দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করেছে, যারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি), সরকারি মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর (মত্স্য অধিদপ্তর, বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ইত্যাদি), বাংলাদেশ নৌবাহিনী (হাইড্রোগ্রাফি শাখা) ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি) এবং দাতা সংস্থা/এনজিওসহ (এফএও, ইউএনডিপি, ওয়ার্ল্ড ফিশ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইত্যাদি) নিজ দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমুদ্রবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছে।
২. সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা
সমুদ্র গবেষণার গোড়াপত্তনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস সমুদ্রবিজ্ঞানে ১ হাজার ৫০০টির বেশি মৌলিক গবেষণা সম্পাদনের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতি প্রসারে বহুমুখী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে ক) বঙ্গোপসাগরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও ইকোসিস্টেম মডেলিং; খ) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন ও আর্থসামাজিক প্রভাব নিরূপণ; গ) সুনীল অর্থনীতির প্রসারে মেরিকালচার প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন; ঘ) পরিবেশবান্ধব চিংড়ির রোগ ব্যবস্থাপনা ও মেরিন বায়োটেকনোলজির প্রয়োগ; ঙ) মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং (এমএসপি) তৈরিতে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও উপস্থাপন; চ) সামুদ্রিক পরিবেশের অবস্থা নিরূপণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মূল্যায়ন; ছ) উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ক্ষুধামুক্ত দেশ গঠনে সমুদ্রসম্পদনির্ভর খাদ্য উৎপাদনে এই ইনস্টিটিউটের ভূমিকা অপরিসীম। সামুদ্রিক চিংড়ি, কাঁকড়া, সি-উইড, শামুক ও ঝিনুক চাষের বেশির ভাগ প্রচলিত প্রযুক্তি এই ইনস্টিটিউটের গবেষকদের উদ্ভাবিত, যা বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি খাতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাগদা চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদনে আধা নিবিড় ও নিবিড় চাষ, প্রজনন কৌশল, আধুনিক হ্যাচারির কৌশল ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তিগুলো ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ গবেষণার ফসল, যা দেশে সামুদ্রিক মত্স্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এ ছাড়া দেশের প্রথম কাঁকড়া, আর্টিমিয়া, সি-উইড ও ঝিনুক (ওয়েস্টার, মাসেল) চাষপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের কৃতিত্বও এই ইনস্টিটিউটের। সাম্প্রতিক সময়ে এই ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, গবেষক ও গ্র্যাজুয়েটদের উদ্ভাবিত নানা উন্নত প্রযুক্তি সুনীল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যা প্রতিফলিত হয়েছে ২০১৬, ২০২১ ও ২০২২ সালে জাতীয় মত্স্য পুরস্কার এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ইউজিসি স্বর্ণপদক প্রাপ্তির মাধ্যমে।
এ ছাড়া পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা, গবেষণা ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ সম্মাননা পদক ২০১৪–এ ভূষিত হয়। বর্তমানে মেরিকালচার উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় একাধিক গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে জীবনমান উন্নয়নে নতুন মেরিকালচার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক মাছ (কোরাল, খরুল বাটা, দাতিনা), সি-উইড, ঝিনুক (ওয়েস্টার, মাসেল) ও কাঁকড়ার সংবলিত চাষ তথা আইএমটিএ প্রযুক্তির পরীক্ষামূলকমূলক গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সুনীল অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রসম্পদনির্ভর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় উত্তর বঙ্গোপসাগরের প্রাণিজ সম্পদের তালিকা প্রণয়ন ও মজুত নিরূপণসহ নানামুখী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সামুদ্রিক মত্স্য, সি-উইড ও শামুক-ঝিনুকের তালিকা ও সচিত্র প্রকাশনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সামুদ্রিক মত্স্যসম্পদের মজুত নিরূপণে বাংলাদেশ সরকারের মত্স্য অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত জরিপ কার্যক্রমে এই ইনস্টিটিউট অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান। জরিপ জাহাজ ‘মীন সন্ধানী’–এর মাধ্যমে সরেজমিন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরিতে এই ইনস্টিটিউটের গবেষকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা জরিপ কার্যক্রমের সফলতা নিশ্চিত করেছে।
এই ইনস্টিটিউটের গবেষকদের উদ্ভাবিত বিশ্লেষণী সফটওয়্যার ও স্যাটেলাইট–নির্ভর জিআইএস ম্যাপিং দক্ষতা জরিপ কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে নরওয়ের সমুদ্র জরিপ জাহাজ ‘আরভি ফ্রেড্ঝফ ন্যানসন’-এর পরিচালিত যৌথ গবেষণা কার্যক্রমেও এই ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মত্স্যসম্পদ ও পরিবেশের বর্তমান অবস্থা নিরূপণের কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় পরিচালিত সামুদ্রিক মত্স্যসম্পদের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্পে ইনস্টিটিউট জনবল ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
৩. সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা
ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দীর্ঘ পথ চলায় অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, দেশের সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ প্রণয়নে অত্র ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মাধ্যমে সরকারের অনুকূলে নদী ও সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের দিকনির্দেশনামূলক নীতিপত্র প্রণয়ন করেছে। সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির সক্ষমতা অর্জনে সরকারের কর্মপন্থা নির্ধারণে বাংলাদেশ সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পে ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং সুনীল অর্থনীতি বাস্তবায়নে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন ও করণীয় নির্ধারণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিরসন পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন সংজ্ঞায়িত সমুদ্র প্রদেশের প্রথম মানচিত্র এই ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা জাতিকে উপহার দেন, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। পরবর্তীকালে, অর্জিত সমুদ্র সীমার অঞ্চলভিত্তিক নানাবিধ ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রাথমিক মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিংয়ের ধারণাপত্র তৈরি করা হয়, যা সমুদ্র ও নদীসম্পদ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত জাতীয় ‘সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ প্রতিবেদনে সংযোজিত হয়েছে।
এ ছাড়া সমসাময়িক অনুসন্ধানমূলক নানা গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে তথ্য দিয়ে এই ইনস্টিটিউট প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরিতে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ক) জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র আবিষ্কার ও ইলিশ ব্যবস্থাপনা; খ) সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত মত্স্য আহরণের প্রভাব; গ) জাহাজভাঙা-শিল্পের পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব ও করণীয়; ঘ) উপকূলীয় অঞ্চলে মত্স্য, চিংড়ি, সি-উইড, ঝিনুক, লবণ চাষের স্থান নির্বাচন ও সম্প্রসারণের উপায়; ঙ) সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও অম্লতা বৃদ্ধির প্রভাব; চ) সমুদ্রে তেজস্ক্রিয়তা, শিল্পবর্জ্য, মাইক্রোপ্লাস্টিক ও অন্যান্য সমুদ্রদূষণের মাত্রা নিরূপণ; ছ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলীয় অঞ্চলের সক্ষমতা নিরূপণ; জ) উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন ও প্রতিরোধের উপায় তথা ইকো ইঞ্জিনিয়ারিং-পদ্ধতির ব্যবহার; ঝ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলীয় সবুজ বনায়ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ম্যানগ্রোভ বনায়নের স্থান নির্বাচন ও সংরক্ষণ; ঞ) জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও হ্রাসের কারণ বিশ্লেষণ; এবং ট) উপকূলীয় জীবন–জীবিকা উন্নয়নের ব্যবস্থাপনাপত্র প্রণয়ন। এই গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন দেশের সমুদ্রসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে। ইনস্টিটিউটের গবেষকদের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের প্রস্তাবিত মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং ও ডেল্টা প্ল্যানসহ সমুদ্রবিষয়ক যেকোনো ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে দেশ ও জাতি বিপুলভাবে উপকৃত হবে।
৪. সমুদ্রবিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার
বাংলাদেশের সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে অত্র ইনস্টিটিউট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন ফিশারিজ একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ জনবল সরবরাহের মাধ্যমে সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক বিভাগ খোলা এবং পাঠ্যসূচি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
এই ইনস্টিটিউট ‘মেরিন সায়েন্স’ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি ও ওশানোগ্রাফিসহ অন্যান্য সমুদ্র–সম্পর্কিত বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করে আসছে এবং ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় দেশে প্রথম ওশানোগ্রাফি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি চালু করে। তদুপরি বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) প্রতিষ্ঠাতেও ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। বোরির (তৎকালীন জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট) প্রারম্ভিক কার্যক্রম শুরু হয় ইনস্টিটিউটের একজন দেশবরেণ্য সমুদ্রবিজ্ঞানীর হাত ধরে যিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইনস্টিটিউটের গ্র্যাজুয়েটরা বোরির প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
সমুদ্রশিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ২০১৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ৭২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। এই প্রকল্পের আওতায় ইনস্টিটিউটের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ভৌত স্থাপনা ও আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি নির্মাণ সম্প্রতি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সমুদ্রসম্পদনির্ভর নানাবিধ কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট একটি ‘ব্লু-ইকোনমি রিসার্চ সেন্টার’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই প্রস্তাব বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবেচনাধীন। মাঠপর্যায়ে সমুদ্র গবেষণা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী গবেষণাগার স্থাপন ও সমুদ্র গবেষণা জাহাজ সংযোজনসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দীর্ঘ ৫০ বছরের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস বাংলাদেশের সমুদ্রবিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার বাতিঘর হিসেবে সঠিক তথ্য-উপাত্ত এবং নির্দেশনা দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। অতএব প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমার সম্পদ এবং তার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনসহ সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কর্মপন্থা ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অত্র ইনস্টিটিউটের গবেষকদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা দেশ ও জাতির কল্যাণ নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী সহযোগী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়