যেহেতু সে পা ছাত্রলীগ নেতার, সেহেতু টেপা মন্দ কিছু নয়!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের পা টেপানোর ছবিটি আজ সোমবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: সংগৃহীত

গান বাজনার মতো ছাত্ররাজনীতিবিদ্যাও একটি মারাত্মক ভক্তিবাদী গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুমুখী বিদ্যার দৌড়ে গুরু ছাড়া বেশি দূর এগোনো যায় না। এই বিদ্যার ভেদ বুঝতে নিজেকে শিষ্যরূপী গরু বানিয়ে মোটাতাজা-পুরু দেখে একটা গুরু ধরতে হয়। গুরুকে গুরুত্ব এবং গুরুদক্ষিণা—দুটোই দিতে হয়। ভক্তিরসের মালিশ দিয়ে গুরুর পা পালিশ করলে হাজার নালিশেও বিচার সালিসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর বালিশ পাওয়া যায়। গুরু গদি ছেড়ে আরও হাই লেভেলের গদিতে গেলে পা টেপা শিষ্যদের মধ্যে যিনি সর্দার, তিনি গদিনশিন হন। পদোন্নতি পাওয়া নতুন গুরুর পদসেবায় বাকি শিষ্যরা সব ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাতের তালুতে সিদ্ধি ফেলে বৃদ্ধাঙ্গুল ঘষে চৈতন্যের খেয়া পার হওয়া সাঁইজির আস্তানার মতোই ছাত্ররাজনৈতিক আস্তানাগুলোতে এই পলিটিক্যাল ভক্তিসেবা নেবার এবং দেবার খেলা চলতে থাকে।

আরও পড়ুন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে হলে যে এই ধরনের পদসেবামূলক আস্তানার অস্তিত্ব আছে, তা ছাত্ররাজনীতির ভক্ত-আশেকান ভালো করেই জানেন। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের ৩১১ নম্বর কক্ষটিকে গুরু-শিষ্যের পদসেবা দেবার–নেবার সেবাশ্রম সংঘ বানিয়ে ফেলার সচিত্র খবরটি বেশ সাড়া ফেলেছে।
ফেসবুকসহ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিছানায় শুয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব রেজাউল হক। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে হাফ প্যান্ট। গলায় দুই তিনটি রুপালি চেইন চক চক করছে। এক ধ্যানে তিনি স্মার্টফোনে চেয়ে আছেন। একদিকে তাঁর আঙুল ফোনের মনিটরে টিপ দিতে উদ্যত, অন্যদিকে তাঁর টান টান করে মেলে ধরা দুই পায়ের দুই পারে অপার হয়ে বসে অপর দুই খাদেম পা টিপে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

গুরুপদসেবী দুই খাদেমের একজন হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপকর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক শামীম আজাদ। উল্টো দিকে ফিরে থাকায় যে অপরজনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তিনি হলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপক্রীড়া সম্পাদক শফিউল ইসলাম। কতটুকু সংযম, আদব–লেহাজ ও নেতাভক্তির ঢিপি থাকলে এইভাবে টেপাটিপি করা যায় তা তাঁরা নিজ হাতে করে দেখিয়েছেন।

শামীম ও শফিউলকে দিয়ে পা টেপানোর বিষয়ে রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, এই ছবিটি করোনা মহামারির সময়ের। তখন ইউরিক অ্যাসিডের কারণে তাঁর পা ফুলে গিয়েছিল। সে কারণে ‘জুনিয়ররা’ তাঁকে সেবা করেছিলেন। তাই এটিকে ‘পদসেবা’ বলা ঠিক হবে না, কারণ তাঁরা (শামীম ও শফিউল) অসুস্থ হলে তিনিও তাঁদের ‘সেবা’ করেন।

দেখা যাচ্ছে, রেজাউলের সঙ্গে যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অন্তত ৯ বছর আগে এম এ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির দুই সদস্যও তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট। অর্থাৎ একজন প্রবীণতম নেতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করে বসে আছেন।
আরও পড়ুন

কিন্তু ‘করোনাকালীন ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল তো বন্ধ ছিল; বন্ধ হলে কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছিল?’ এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল বলেছেন, ‘তাহলে ছবিটি বছরখানেক আগের হবে। সঠিক তারিখ মনে পড়ছে না।’ তাঁর কথায় আন্দাজ হয়, শুধু পা ফোলা রোগ নয়, তাঁর স্মৃতিভ্রম রোগও আছে। কারণ বয়স তাঁর বড়ো কম হয়নি।
প্রথম আলোর খবরে দেখা যাচ্ছে, দশ বছর আগে রেজাউল এম এ পাশ করেছেন। অর্থাৎ দশ বছর আগে তাঁর ছাত্রত্ব গেছে। কিন্তু তিনি তিন আসনের এই কক্ষটিকে পৈতৃক সম্পত্তিজ্ঞানে একাই দখল করে আছেন। চাইলে সেই তিন আসনের কক্ষে বউ–বালবাচ্চা নিয়ে বসবাস করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বলছে, রেজাউল পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন ১৭ বছর আগে। অনার্স শেষ করেন ২০১০ সালে। এমএ পাস করেন ২০১৩ সালে। সম্ভবত লেখাপড়ার পরিবেশের ওপর বেধড়ক মায়া পড়ে যাওয়ায় রেজাউল কক্ষটিকে ছাড়েননি। ছাত্রলীগও তাঁর বিদ্যোৎসাহে মুগ্ধ হয়ে ২০১৯ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির পদে বসায়। সভাপতির মেয়াদ এক বছর। সেই মেয়াদ পার হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো এই পদে আছেন।

আরও পড়ুন

দেখা যাচ্ছে, রেজাউলের সঙ্গে যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অন্তত ৯ বছর আগে এম এ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির দুই সদস্যও তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট। অর্থাৎ একজন প্রবীণতম নেতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির পদ অলংকৃত করে বসে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি প্রথম আলোকে বলেছেন, রেজাউলের বিরুদ্ধে অতীতে একাধিকবার নারীসংক্রান্ত অপকর্ম এবং চাঁদাবাজি নিয়ে সংঘাতে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল। তবে সেসব অভিযোগ এই প্রবীণ ছাত্রনেতা (!) ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন।

তবে এই নেতার পা টেপাটিপি বিষয়ক ছবি ও খবর দেখে উপলব্ধির অন্তর্লোক থেকে যে অবজেকটিভ টাইপের প্রশ্ন ফুঁচকি মারছে, তা হলো: আরেকজনের পা টিপে দেওয়ার মধ্যে যে গ্লানি ও অসম্মান আছে তা উপলব্ধি করার মতো ব্যক্তিত্ববোধ কি ছাত্রলীগ করতে গেলে অর্জন করার বদলে বিসর্জন দিতে হয়? হ‌ুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকে বাড়ির কেয়ারটেকার কাদের হাজতে যাওয়ার পর এক হাজতি তাঁকে পা টিপতে বলায় কাদেরের জবাব ছিল, ‘ ভাইজান, আমি সৈয়দ বংশের পোলা, পায়ে হাত দেওয়ায় নিষেধ আছে।’

আরও পড়ুন

সেই কেয়ারটেকার কাদেরের মধ্যে যতটুকু আত্মসম্মানবোধ দেখা গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম ও সফিউলের মধ্যে সেটুকুও দেখা গেল না।

এই ‘গুরুমুখী’ ছাত্ররাজনীতির ব্যক্তিত্বরিক্ত অতিভক্তির দৌরাত্ম্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে যে সিলসিলা কায়েম করছে, তা তো শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে ধেড়ে সাইজের ধামাধরা বানানোর সব আয়োজন সেরে রেখেছে। এই শিক্ষার্থীরাই যখন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারে বসবেন, তখন তো তাঁরা নিজেদের গুরুতর গুরুত্বপূর্ণ গুরু ভাববেন এবং অভ্যাসগত কারণে অন্য সংখ্যাগুরু সবাইকে শিষ্য ভেবে টেপার জন্য পা এগিয়ে দেবেন।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]