ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামের অনেক দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। রুশ ট্যাংকের বিস্ময়কর ক্ষয়ক্ষতি, তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষের ওপর বিমানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ান বিমানবাহিনীর ব্যর্থতা এবং রাশিয়ান ব্ল্যাক সি ফ্লিটের প্রধান রণতরি মস্কভা ফ্ল্যাগশিপের ডুবে যাওয়া রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর অনেক সামরিক ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরছে।
যদিও কিছু বিপর্যয়ের জন্য দুর্বল কমান্ড এবং সেনা প্রেরণার অভাবসহ দুর্বল প্রশিক্ষণকে দায়ী করা যেতে পারে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরঞ্জামগুলোর সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়নি। কেন? এর উত্তর খুঁজতে ইতিহাসের দিকে ফিরতে হবে।
সোভিয়েত আমলে আমেরিকান এবং অন্যান্য পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র মোকাবিলায় রাশিয়া শক্তপোক্তভাবে সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করেছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ইয়াক-৩, লাভোচকিন এলএ-৭ এবং ইলিউশিন-২ স্টর্মোভিকের মতো যুদ্ধবিমান বানিয়েছিল। রাশিয়ান অস্ত্র সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সফল ট্যাংক টি-৩৪। এটি ঢালু বর্মসহ প্রথম আধুনিক যুদ্ধ ট্যাংক।
টি-৩৪ ট্যাংকে একটি ইনডিপেনডেন্ট সাসপেনশন সিস্টেম রয়েছে, মূলত যার ডিজাইন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জন ওয়াল্টার ক্রিস্টি। এ ছাড়া রাশিয়া কার্যকরভাবে যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন, ফাইটার বিমান এবং বোমারু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ভারী আইসিবিএমসহ সব ধরনের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে।
১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে রাশিয়া তার সামরিক বাহিনীকে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিল। তারা সে সময় বিপুল পরিমাণে আধুনিক সরঞ্জাম কিনেছিল এবং দেশটি সম্ভবত তার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সামরিক ব্যয়ে ঢালার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতের এই রণসজ্জার সঙ্গে তাল মেলাতে ১৯৮২ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় তার জিডিপির ৬.৮ শতাংশে উন্নীত করে। যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তী বেশ কয়েক বছর সেই ব্যয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ২০০০ সালে রাশিয়া প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ পরিমাণে আনে।
যুক্তরাষ্ট্রে আরও উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা ছিল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মাইক্রো-ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটারভিত্তিক প্রযুক্তি এবং জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য গুঁড়া ধাতু ও তা প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কম্পোজিটসহ অত্যাধুনিক উপকরণ ছিল। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিসর এবং সিরিয়ার হাতে থাকা রাশিয়ান সরঞ্জাম পশ্চিমা সরঞ্জামে সজ্জিত ইসরায়েলকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিল। কারণ, তখন রাশিয়ান সরঞ্জাম উচ্চমাত্রায় প্রাণঘাতী এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তিনির্ভর ছিল।
১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান সামরিক ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশের কম ছিল। তারপর থেকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ঘটেছে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা উৎপাদন এবং আধুনিকায়ন এখনো খারাপভাবে পিছিয়ে রয়েছে। বাস্তবিক কারণে রাশিয়ায় প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবের অর্থ হলো সরঞ্জামগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বা নবায়ন করা হয়নি।
ওই সময় ইসরায়েলের জব্দ করা কিছু রাশিয়ান অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমি পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেগুলোর বেশির ভাগ ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যদিও এর কিছু মার্কিন সিস্টেমের নকল করা, তবু সেগুলো যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। রুবলের মূল্য পড়ে যাওয়ায় নতুন আবির্ভূত রাশিয়া ভয়ানক অর্থনৈতিক ধাক্কার সম্মুখীন হয় এবং সাবেক সোভিয়েত আমলের কয়েক হাজার প্রতিরক্ষাকর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। এরপর থেকে সামরিক সরঞ্জামের পেছনে রাশিয়া আগের মতো অর্থ ঢালেনি।
১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান সামরিক ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশের কম ছিল। তারপর থেকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ঘটেছে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা উৎপাদন এবং আধুনিকায়ন এখনো খারাপভাবে পিছিয়ে রয়েছে। বাস্তবিক কারণে রাশিয়ায় প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবের অর্থ হলো সরঞ্জামগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বা নবায়ন করা হয়নি।
ওরিক্সপিয়োনকোপ নামের একটি ডাচ ওপেন-সোর্স গোয়েন্দা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণ ওয়েবসাইট এবং যুদ্ধবিষয়ক গবেষণা গ্রুপের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ৯৯০টি ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬১০টি, পরিত্যক্ত হয়েছে ৪০টি এবং ইউক্রেনীয়দের কাছে আটক হয়েছে ২৮৫টি।
রাশিয়ান ট্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। তবে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র এতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। রাশিয়ার এ ট্যাঙ্কগুলোর বেশির ভাগ অংশে হালনাগাদ করা বর্ম ছিল না। সেগুলো সক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সজ্জিত ছিল না।
রাশিয়ান ড্রোনগুলো পশ্চিমা এবং চীনা ইলেকট্রনিকসের সংমিশ্রণে বানানো এবং এতে খুব কম রাশিয়ান যন্ত্রাংশ আছে। যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য সুরক্ষিত ফোনগুলোও একইভাবে, অ-রাশিয়ান মাইক্রোপ্রসেসর এবং গ্রাফিকস ইঞ্জিনগুলোর ওপর ভিত্তি করে বানানো। এর যন্ত্রাংশ শুধু রাশিয়ায় জোড়া লাগানো হয়েছে।
রাশিয়া এমনকি আমেরিকান সফটওয়্যার এবং অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছে। বাণিজ্যিক হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার ব্যবহার করা প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা যোগ করার একটি দ্রুত উপায়। তবে এর ত্রুটি রয়েছে। বাণিজ্যিক হার্ডওয়্যার সাধারণত হ্যাকিং বা অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে খুব নিরাপদ নয়।
এ অস্ত্রের আধুনিকায়ন কিংবা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে পিঠের পেছনে অন্তত একটি হাত বেঁধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্টিফেন ব্রায়েন নিরাপত্তা কৌশল এবং প্রযুক্তির একজন নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন