শুল্ক ফাঁকি আর অর্থ পাচার এক নয়

সম্প্রতি একটি সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (পণ্যের দাম কম দেখানো) মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ১ লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি নাকি ২০ হাজার ডলারে আমদানির জন্য এলসি বা ঋণপত্র খোলা হয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ওই গাড়ি আমদানির জন্য আমদানিকারক ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে বাকি ৮০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার হওয়ার কথা বলতে গিয়ে পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার এই উদাহরণ দিয়েছেন।

গভর্নর সাহেবের এই অকপট স্বীকারোক্তি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে এবার এই মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির আমদানিকারক ধরা খেয়ে গেলেও এটা যে প্রায়ই হচ্ছে এবং তাঁরা তা সফলভাবে করতে পারছেন, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ওই দামি গাড়ির আন্তর্জাতিক বাজারের দাম মোটামুটি সবারই জানা থাকায় এই ধরনের আন্ডার ইনভয়েসিং হতে পারার কথা নয়। হচ্ছে, কারণ ব্যাংক ও শুল্ক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি আছে বলেই। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং আরও সহজেই করতে পারার কথা এবং তা হচ্ছেও। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রি (জিএফআই), ওয়াশিংটন ভিত্তির গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাদের ২০২১ সালের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম বেশি দেখানো) অনুপাত ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছে। এই অনুপাত নিয়ে আলোচনায় আসব আরেকটু পরে।  

অতএব জিএফআই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচারের দাবি ও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা অনুচিত। কেননা, এ ধরনের দাবি সরকারের নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা ও তা বাস্তবায়নের অক্ষমতাকে অনেকটা আড়াল করে দেয়। দোষারোপ করার জন্য অদৃশ্য কাউকে কাউকে বলির পাঠা হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ করে দেয়।

তবে গভর্নর মহোদয় ওই ৮০ হাজার ডলার, যা ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে পাঠান, তাকে কেন বিদেশে অর্থ পাচার বললেন, সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। কারণ, নিয়মসিদ্ধভাবে ওই গাড়ি এলেও আমদানিকারককে ১ লাখ ডলারই পরিশোধ করতে হতো। ওই ৮০ হাজার ডলার ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এলেও ব্যবসায়ী সমপরিমাণ অর্থ টাকায় পরিশোধ করে ওই ডলার বিদেশে মার্সিডিজ রপ্তানিকারকের কাছেই পাঠাতেন। ব্যাংকব্যবস্থা কিছু কমিশন পেত। রিজার্ভে ৮০ হাজার ডলার যোগ হয়ে তা আবার বিয়োগ হয়ে যেত। ফলে গাড়ি আমদানি হলে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রশ্নই আসে না।

এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো শুল্ক ফাঁকি। মার্সিডিজ গাড়ির ক্ষেত্রে যে বিশাল শুল্ক সরকারকে পরিশোধ করতে হতো, আমদানিকারক তা ফাঁকি দিয়েছেন। অন্যদিকে ১ লাখ ডলার বিদেশে পাঠিয়ে ২০ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করলে ৮০ হাজার ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যেত। যদিও ওই ৮০ হাজার ডলারের ওপর অতিরিক্ত কিছু শুল্ক আদায় হতো। অনুরূপভাবে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি সুবিধা নেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

এ ক্ষেত্রে জিএফআইয়ের ২০২১ সালের রিপোর্টটি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তার ওপর খানিকটা আলোকপাত করা যাক। এই সংস্থা তার ‘ট্রেড রিলেটেড ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ইন ১৩৪ ডেভেলপিং কান্ট্রিস ২০০৯-২০১৮’ রিপোর্টে বিশ্বের ১৩৪টি দেশের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়, তার ওপর একটি সংখ্যাগত ধারণা দিয়েছে। এই মিসইনভয়েসিং গণনার যে পদ্ধতি এই রিপোর্ট প্রস্তুতকারীরা ব্যবহার করেছেন, তা একটু ব্যাখ্যা করলে পরবর্তী আলোচনা বুঝতে একটু সুবিধা হতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রতিবছর তাদের আমদানি-রপ্তানির যে বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করে, জিএফআই সেই ডেটাবেজ ব্যবহার করে এই রিপোর্টটি প্রণয়ন করেছে। দুটি  ব্যবসায়িক অংশীদার দেশ পরস্পর আমদানি-রপ্তানির যে তথ্য প্রদান করে থাকে, তার ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি প্রতিটি ট্রেডেড পণ্যের ক্ষেত্রে মিসইনভয়েসিং গণনা করে এই ক্ষেত্রে। রিপোর্টে পদ্ধতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, যদি ব্রাজিল ২০১৬ সালে চীন থেকে ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের লাইট বাল্ব আমদানি রিপোর্ট করে থাকে, কিন্তু চীন একই বছর ব্রাজিলে ৩ মিলিয়ন ইউএস ডলারের লাইট বাল্ব রপ্তানি রিপোর্ট করে থাকে, তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই দুই ব্যবসায়িক অংশীদারের মধ্যে ২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ‘ভ্যালু গ্যাপ’ থাকবে ওই বছরের জন্য লাইট বাল্ব পণ্যের ক্ষেত্রে।  

এই ‘ভ্যালু গ্যাপ’ নানা কারণে হতে পারে। হতে পারে ব্রাজিলের ব্যবসায়ীরা প্রকৃত ভ্যালু রিপোর্ট করেছেন, কিন্তু চীনের ব্যবসায়ীরা রপ্তানি আন্ডার ইনভয়েসিং করেছেন। কিংবা চীনের ব্যবসায়ীরা সঠিক ভ্যালু রিপোর্ট করেছেন, কিন্তু ব্রাজিলের ব্যবসায়ীরা আমদানি ওভার ইনভয়েসিং করেছেন। অথবা চীনের ব্যবসায়ীরা খানিকটা রপ্তানি আন্ডার ইনভয়েসিং করেছেন এবং ব্রাজিলের ব্যবসায়ীরা খানিকটা আমদানি ওভার ইনভয়েসিং করেছেন। মোটকথা, ‘ভ্যালু গ্যাপ’ ২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এখন ধরা যাক, ২০১৬ সালে ব্রাজিল ১০ মিলিয়ন ডলারের কাঠ চীনে রপ্তানির রিপোর্ট করেছে, কিন্তু চীন ব্রাজিল থেকে একই সময়ে ৮ মিলিয়ন ডলারের কাঠ আমদানির রিপোর্ট করেছে। এখানে ট্রেড ভ্যালু গ্যাপ আরও ২ মিলিয়ন ডলার। যদি এভাবে সরলীকরণ করি যে এই দুই দেশের মধ্যে এই দুই পণ্যই বাণিজ্য হয় এবং এরা অন্য কোনো তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে না, তবে চীনের মোট ট্রেড ভ্যালু হবে ১১ মিলিয়ন ইউএস ডলার আর ব্রাজিলের ১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। মোট ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ হবে ৪ (= ২ + ২) মিলিয়ন ডলার উভয় দেশের ক্ষেত্রেই।  

আরও পড়ুন

যখন বিশ্বের সব ট্রেডিং অংশীদার ও সব পণ্য বিবেচনায় আনা হয়, তখন ২০১৮ সালে চীনের ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ দাঁড়ায় ৫৪৬.৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৪৫.৫ বিলিয়ন ডলার ব্রাজিলের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কয়েক বছরের ডেটা না থাকায় গড়ে প্রতিবছর ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার ‘ভ্যালু গ্যাপ’ দেখানো হয়েছে ২০০৯-২০১৮ সময়কালে। যা মোট ট্রেড ভ্যালুর ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এই ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’কেই আমাদের বিভিন্ন লেখালেখি ও আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ডলার পাচারের পরিমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং মূলত তার সঙ্গেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে সংযোগ করছে অনেকেই।

প্রশ্ন হলো, জিএফআই প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিবছর কত বিলিয়ন ডলার পাচার হলো? প্রথমত, এই প্রতিবেদন পাচার-সংক্রান্ত কোনো পরিমাণ কিংবা তথ্য প্রকাশ করেনি সরাসরিভাবে। এই প্রতিবেদন দেখাতে চেয়েছে যে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ট্রেড ইনভয়েস বিকৃত করা একটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে। এ কারণে এই দেশগুলো বিশাল অঙ্কের শুল্ক আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এটা রোধ করতে পারলে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ও কোভিড-১৯ স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ দরকার, তার খানিকটা অর্জন করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রতিবছর গড় ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’-এর কতটা বাংলাদেশের দিক থেকে মিসইনভয়েসিং এবং এর কতটা ট্রেড অংশীদার দেশসমূহের দিক থেকে মিসইভয়েসিং, সেটা অজানা। বাংলাদেশের আমদানির বড় অংশীদার চীনের ক্ষেত্রে ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ ২১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভারতের ক্ষেত্রে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অতএব বাংলাদেশের ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’-এর একটা অংশ ট্রেড অংশীদার দেশসমূহের মিসইনভয়েসিংয়ের জন্য হওয়াটা স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত, আমদানির আন্ডার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে শুল্ক ফাঁকির জন্য, ওভার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে ডলার পাচারের জন্য, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে ডলার পাচারের জন্য এবং এর ওভারইনভয়েসিং হয়ে থাকে বিভিন্ন ধরনের রপ্তানি প্রণোদনার অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রেও আমরা জানি না, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের মিসইনভয়েসিংয়ের কতটা বিদেশে ডলার পাচারের জন্য আর কতটা শুল্ক ফাঁকিও অবৈধ রপ্তানি প্রণোদনা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।
 
অতএব জিএফআই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচারের দাবি ও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা অনুচিত। কেননা, এ ধরনের দাবি সরকারের নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা ও তা বাস্তবায়নের অক্ষমতাকে অনেকটা আড়াল করে দেয়। দোষারোপ করার জন্য অদৃশ্য কাউকে কাউকে বলির পাঠা হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ করে দেয়। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে এই পাচারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে এই ধরনের পাচার সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে এবং তা অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক বড়, যা আমরা আপাতত দেখতে পাচ্ছি না তথ্যগত ভাব।

জিএফআই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ ২০০৯ সালের ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার হলেও ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ অনুপাত ২০০৯ সালের ১৮ শতাংশ ২০১৫ সালে ও অটুট রয়েছে যদিওবা গড় হার কমে নেমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তার মানে ট্রেড ভ্যালুর সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে ট্রেড ‘ভ্যালু গ্যাপ’ ও বেড়েছে। অর্থাৎ অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে শুল্ক ফাঁকি ও পাচারও হয়তো বেড়েছে। ফলে হঠাৎ করে পাচার অনেক বেড়েছে তা বলা যায় না এবং পাচারের সঙ্গে বর্তমান সংকটকে কার্যকারণ সম্পর্কে দাঁড় করানোও যায় না।  

  •  ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন  অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিচালক (গবেষণা), সিরডাপ।