এত কিছুর পরও কেন ইভিএমেই ভোট করতে হবে?

শুরু থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয়েছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ইভিএম কেনা ও মেরামত করা। এই ব্যাধি অবশ্য তারা উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছে।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন বলেছিল, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, যেন তারা ভোটারদের তকলিফ নিয়ে খুবই বিচলিত ছিল। ভোটাররা কষ্ট করে ব্যালটে সিল মারবেন, এটা তাদের পছন্দ নয়। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট করতে গিয়েও কমিশন লেজেগোবরে অবস্থা করেছিল। বর্তমান ইসি ইভিএমে অনেকগুলো নির্বাচন করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। যার সর্বশেষ উদাহরণ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ইভিএমের ধীরগতির কারণে ভোটারদের রাত আটটার পরও ভোট দিতে হয়েছে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের শুরুটা ভালো ছিল, অন্তত কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সঙ্গে তুলনা করলে। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার লক্ষ্যে তাঁরা দফায় দফায় রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। সাবেক কয়েকজন নির্বাচন কমিশনারের (যাঁদের মধ্যে একাধিক সিইসিও ছিলেন) পরামর্শ করলেন। এসব আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ইভিএম নয়, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

নির্বাচন কমিশনের অজানা নয় যে ইভিএমের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল ইভিএমে ভোট করার পক্ষে। বিএনপিসহ অনেকগুলো বিরোধী দল ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইভিএম থাকা না থাকা বড় সমস্যা নয়, এ জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা বা ঐকমত্য প্রয়োজন। তাঁরা বলেছেন, সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সঙ্গে বর্তমান কমিশনের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। পূর্বসূরিরা সবকিছুতে সরকারের মুখাপেক্ষী ছিল।

যেহেতু ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের প্রতিশ্রুত ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতে পারছে না, সেহেতু ইভিএমে ভোট করার চিন্তা পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। কমিশন ২৪০–২৫০টি আসনের নির্বাচন ইভিএম ছাড়া করতে পারলে বাকিগুলোতে নয় কেন? তারা নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক ঐকমত্য চাইছে, এটা তারও ভিত্তি হতে পারে।

বর্তমান কমিশনের চেষ্টা আছে সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার, যদিও সেই চেষ্টা মাঝেমধ্যেই হোঁচট খায়। গাইবান্ধা উপনির্বাচনে হাবিবুল আউয়াল কমিশন খুবই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। একটি আসনের পুরো নির্বাচন স্থগিত করার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়েই তারা আপস করে ফেলল। উপনির্বাচন নিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারি হলো, অথচ রিটার্নিং কর্মকর্তা কিংবা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী দায়মুক্তি পেয়ে গেলেন।

নির্বাচন কমিশন রংপুর কিংবা কুমিল্লায় যে ভালো নির্বাচন করেছে, এ জন্য কমিশন খুব বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। সরকার বা সরকারি দল হস্তক্ষেপ করেনি বলেই এ দুটি নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু যেই নির্বাচনে সরকার বা ক্ষমতাসীনেরা প্রভাবিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু করাই হলো কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ এ পর্যন্ত কোনো কমিশন নিয়েছে বলে প্রমাণ নেই। যে চারটি জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ও কম বিতর্কিত হয়েছে, সেই নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীনেরা ভোটের অংশীদার ছিল না। ফলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে, যখনই ক্ষমতাসীনেরা ভোটের অংশীদার হয়েছে, গোল বেঁধেছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৮ সালের আগে দিনের ভোট রাতে হওয়ার অপবাদ শোনা যায়নি।

ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। যখন অনেক দেশ এই পদ্ধতি বাদ দিয়েছে, তখন বাংলাদেশের নির্বাচন  কমিশন এই পদ্ধতি গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। বলতে গেলে বছরজুড়েই ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক চলছে। আওয়ামী লীগ কমিশনের কাছে গিয়ে বলল, তারা তো ৩০০ আসনেই ইভিএম দেখতে চায়। বিএনপি বলল, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। আওয়ামী লীগের ভোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিও ইভিএমের বিষয়ে আপত্তি জানাল।

নির্বাচন কমিশন বেকায়দায় পড়ল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল  দু-একবার এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথাও বলেছিলেন। এমনকি তিনি একবার ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন যে বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। পরবর্তীকালে কমিশন তাদের সেই অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসে। তাদের কর্মকৌশলে বলা হয়েছে, নির্বাচনে আসতে ইচ্ছুক দলগুলোর অংশগ্রহণে যে নির্বাচন হবে, সেটাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কমিশনের এই বয়ানে ক্ষমতাসীনদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়। নির্বাচন কমিশন ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে এর আগে ঘোষণা দিয়েছিল, গতকাল মঙ্গলবার তা থেকে সরে আসে। তারা ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে দুই লাখ ইভিএম কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল, সদাশয় পরিকল্পনা কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে আর্থিক অসংগতির দোহাই দিয়ে। যদিও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে যে ইভিএম বাদ দেওয়া হয়েছে কেবল অর্থনৈতিক কারণে নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও আছে। বিরোধী দল ইভিএমে ভোট করার বিরোধিতা করছে। অন্তত এর মাধ্যমে তাদের একটি দাবির আংশিক পূরণ হলো।

সহকর্মী রিয়াদুল করিম মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোয় একটি  টাটকা খবর দিলেন। খবরটি হলো নতুন ইভিএম কেনার প্রকল্প স্থগিত হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের হাতে থাকা ইভিএমগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০১৮ সালে তারা যে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল, সেগুলোর কতটি ব্যবহারের উপযোগী আছে, তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে কমিশন। এটা শেষ হলে বলা যাবে, আগামী সংসদ নির্বাচনে কতটি আসনে ইভিএমে ভোট করা সম্ভব হবে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে (প্রকল্প স্থগিত হওয়া) বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশা পূরণ হলো।

আরও পড়ুন

বিশিষ্ট নাগরিকদের যে ইচ্ছা ছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হলো। এখন আমরা মনে করি, দলমত-নির্বিশেষে বর্তমান সিদ্ধান্ত পছন্দ করবে।’ নির্বাচন কমিশন যদি সত্যি সত্যি চায় নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক, তাহলে তাদের উচিত হবে ইভিএমের পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করা। বিরোধী দল সরকারের পদত্যাগসহ যে ১০ দফা দাবি পেশ করেছে, তার অনেক কিছুই নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত। কিন্তু ইভিএমে ভোট করা না করা সম্পূর্ণ তাদের এখতিয়ার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ইভিএমের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।

যেহেতু ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের প্রতিশ্রুত ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতে পারছে না, সেহেতু ইভিএমে ভোট করার চিন্তা পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। কমিশন ২৪০–২৫০টি আসনের নির্বাচন ইভিএম ছাড়া করতে পারলে বাকিগুলোতে নয় কেন? তারা নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক ঐকমত্য চাইছে, এটা তারও ভিত্তি হতে পারে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]