ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বড় জয়ের নানামুখী বিশ্লেষণ চলছে। একেক জন একেক দিককে গুরুত্ব দিয়ে এই ফলাফলকে ব্যাখ্যা করছেন। নিজের বিচার-বিবেচনা, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও অবস্থান এবং উইশফুল থিংকিং বা নিজের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে এগুলো মানুষ গ্রহণ করবে বা করবে না। এমন কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমরা পাব না যা সব মানুষের কাছে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে হবে। এসব আলোচনা চলতেই থাকবে।
ডাকসু কার দখলে থাকল, জাতীয় রাজনীতিতে তা কোনো প্রভাব ফেলে কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। কিন্তু ‘জাতীয় রাজনীতি’ সব সময়েই ডাকসুকে গুরুত্ব দেয়। এ জন্য জোর জবরদস্তির ঘটনাও ঘটেছে। তা ব্যালট বক্স ছিনতাই (১৯৭৩ সালের নির্বাচন) বা আগে ব্যালট বক্স ভরে রাখাসহ নানা কৌশলে( ২০১৯ সালের নির্বাচন) যেভাবেই হোক না কেন। আবার ক্ষমতাসীন দল যখন মনে করে ডাকসুতে তাদের জেতার সুযোগ নেই তখন তারা নির্বাচনই দেয় না।
এবারের ডাকসু নির্বাচন হয়েছে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবং একটি রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ পরিস্থিতি নানা সময়ে তৈরি হয়েছে এর কোনোটির মাত্রাগত গভীরতাই জুলাই অভ্যুত্থান বা শেখ হাসিনাকে উৎখাতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেই ঘটনার এক বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে আমরা দেখলাম পুরোনো বা প্রচলিত কোনো হিসাব-নিকাশ কাজ করেনি।
বাংলাদেশে সব আমলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কার্যক্রম ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। ছাত্র সংগঠনগুলো মিলে মিশে সিদ্ধান্ত নিয়েই তা ‘কার্যকর’ করেছে। কিন্তু গত ১৫ বছরে কীভাবে কী ঘটেছে তা ছিল আমাদের জানা বোঝার বাইরে। শিবিরের লোকজন যে ‘গুপ্ত শিবির’ হিসেবে ছাত্রলীগে আশ্রয় নিয়ে কাজ করে গেছে তা আমরা জেনেছি গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে। সেই অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরে প্রকাশ্য কার্যক্রমের বয়স মাত্র ১ বছর। তাদের এই বিপুল বিজয় অনেকের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত।
গত ১৫ বছরে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। একতরফা নির্বাচন ও দিনে-রাতে ব্যালট বাক্স ভরে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থন বা শক্তি-সামর্থ্য মাপার কোনো সুযোগ হয়নি।
এই দলের এত ভাগ ভোট, ওই দলের কম-বেশি এত ভাগ ভোট বা অমুক পন্থীদের ভোট এত ভাগ- এমন একটি হিসাব-নিকাশ যে আমরা করি তার ভিত্তি আসলে ২০০৮ সাল বা এর আগের নির্বাচনগুলো। গত ১৬ বছরে নতুন ভোটার হিসেবে একটি বড় জনগোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশই কখনো ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। এই নতুন ভোটারেরা কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তিকে ভোট দেবে তা আমাদের জানা-বোঝার বাইরে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি একসময় নানা মহল থেকে উঠেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি। দেশ এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ভাগে নির্বাচন হওয়ার কথা। এর আগে শুধু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। জাকসুর নির্বাচন গতকাল হয়েছে। রাকসু ও চাকসুর নির্বাচন বাকি আছে। বলা যায় জাতীয় নির্বাচনের আগে ছোট এবং ভিন্ন পরিসরে হলেও এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদের নির্বাচনই এক অর্থে দলগুলোর সমর্থন ও রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য ও সাংগঠনিক ক্ষমতা পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র। এর মধ্যে ডাকসুর প্রভাব স্বভাবতই সবচেয়ে বেশি।
ডাকসুতে শিবিরের জয়ের সুবিধা জাতীয় বা নির্বাচনী রাজনীতি জামায়াত পেতে পারে বা নাও পেতে পারে। কারণ তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিএনপির মতো বড় দল এখন আর জামায়াতের শক্তিকে খাটো দেখবে বলে মনে হয় না। তারা এখন নিশ্চয়ই হিসাব-নিকাশ করেই জামায়াতকে মোকাবিলার কৌশল নেবে। বোঝা যাচ্ছে, সামনের জাতীয় নির্বাচনে ডাকসুর ফলাফল প্রভাব হতে পারে নানামুখী।
প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘ডাকসুর ফলাফলে বিএনপি বিব্রত, জামায়াত উচ্ছ্বসিত’। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল কি শুধু দল দুটির ‘উচ্ছ্বাস’ আর ‘বিব্রত’ হওয়ার মধ্যেই আটকে থাকবে? নাকি জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন হিসাব নিকাশের সূচনা ঘটাবে? বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের সময় যখন এগিয়ে আসছে।
আমরা জানি যে গণ-অভ্যুত্থানের পর এক বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তার কথা শোনা যায়। গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশিত সংস্কার বা জুলাই সনদ নিয়ে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়ে গেছে। ডাকসুর ফলাফল অন্তত বিএনপি ও জামায়াতের কৌশল ও চিন্তা-ভাবনায় কতটা পরিবর্তন আনে সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই দল দুটির রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের যে কোনো পরিবর্তন সামগ্রিক রাজনৈতিক হিসাব নিকাশে পরিবর্তন ঘটাবে।
আগেই বলেছি ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বড় জয় নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে। এর মধ্যে সংগঠনটির কৌশল বদল, প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে নিজেদের উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নেওয়া নানা উদ্যোগের বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে।
বলা হচ্ছে, শিবিরের এসব কৌশল কাজে দিয়েছে। এমনকি আমরা দেখলাম ডাকসুর শিবির প্যানেলের নির্বাচিতরা রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে দোয়া-খায়ের করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতও কি এসব কৌশলকে দস্তুর মানবে? মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে, নারী ইস্যুতে জামায়াতের রাজনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন আসবে?
ছাত্রদলের পরাজয়ের বিভিন্ন কারণের মধ্যে তাঁদের প্রস্তুতিহীনতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার অভাব যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি সংগঠনটির ভাবমূর্তির সমস্যার বিষয়টিও অনেকের আলোচনায় পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে চরিত্রগত বিবেচনায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল একই সঙ্গে উচ্চারিত দুটি নাম। তবে গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অপকর্ম ও অত্যাচার-নির্যাতন সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই দুঃসহ সময় ক্যাম্পাসে ফিরে আসুক তা শিক্ষার্থীরা কোনো ভাবেই চাইবে না।
কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা সম্ভবত ছাত্রদলের ওপর ভরসা করতে পারেনি। কারণ ছাত্রদলের ইতিহাসও এ ক্ষেত্রে খুব ভালো নয়। তা ছাড়া ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ছাত্রদলসহ বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বিরুদ্ধে দখলদারি ও চাঁদাবাজির যত অভিযোগ উঠেছে সেটাও শিক্ষার্থীদের ছাত্রদল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এসব নানা বিবেচনায় ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা বিকল্প হিসেবে ছাত্র শিবিরকে বেছে নিয়েছে।
জাতীয় রাজনীতিতে যদি একই হিসাব-নিকাশ কাজ করে তবে দল হিসেবে বিএনপির জন্য তা বিপদের বিষয়। নির্বাচনের আর ৫ মাসের মতো সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে তারা নিজেদের কতটা বদলাতে পারবে? দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নানা অপকর্ম সম্ভাব্য ভোটারদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখে গেছে দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকলেও গত ১ বছরে বিএনপি এই নেতা-কর্মীদের ঠেকাতে বা থামাতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর এটা বলা যায় যে, বড় দল হিসেবে বিএনপি আগামী নির্বাচনে জয়ী হবেই— এমন আত্মবিশ্বাসও দলটির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে যারা জামায়াত ও শিবিরের ঘোরতর বিরোধী তাদের অনেকে মনে করেন ডাকসুতে শিবিরের জয় ঠেকাতে শিবির বিরোধী সংগঠনগুলোর জোট গড়ে মাঠে নামা উচিত ছিল। জাতীয় নির্বাচনে জোট গড়ার ক্ষেত্রে ডাকসুর এই অভিজ্ঞতা প্রভাব ফেলতে পারে। নির্বাচনী জোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে যে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ ও আলোচনা চলছিল ডাকসু নির্বাচনের পর সেই আলোচনা নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন মাত্রা পাবে। ডাকসুতে এনসিপির ছাত্র সংগঠনের খারাপ ফল জাতীয় রাজনীতিতেও তার দর-কষাকষির ক্ষমতা কমাতে পারে।
ডাকসুতে শিবিরের জয়ের সুবিধা জাতীয় বা নির্বাচনী রাজনীতি জামায়াত পেতে পারে বা নাও পেতে পারে। কারণ তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বিএনপির মতো বড় দল এখন আর জামায়াতের শক্তিকে খাটো দেখবে বলে মনে হয় না। তারা এখন নিশ্চয়ই হিসাব-নিকাশ করেই জামায়াতকে মোকাবিলার কৌশল নেবে। বোঝা যাচ্ছে, সামনের জাতীয় নির্বাচনে ডাকসুর ফলাফল প্রভাব হতে পারে নানামুখী।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
