জীবনের শেষযাত্রায় কেউ নিজের শরীরটাকেও অবিচ্ছিন্ন রাখতে পারছেন না। এ বড় নির্মম নিয়তি। পত্রিকায় চোখ রেখে পড়তে হয় খুন করে দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলার খবর। গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে পতেঙ্গায় একটি ট্রলি ব্যাগের মধ্যে পাওয়া যায় মানুষের শরীর আটটি টুকরা। মাথাটা ছিল না। হাসান আলী নামের এই মানুষের অন্তিমযাত্রার এমন ব্যবস্থা করেছেন তাঁরই স্ত্রী ও সন্তানেরা। সেই নৃশংস ঘটনার বিবরণ তাঁরা জবানবন্দিতে দিয়েছেন।
১০ অক্টোবর কক্সবাজারে পেকুয়ায় আবু ছৈয়দ নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে তাঁর একটি পা কেটে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। নিহত আবু ছৈয়দ নিজেও এক হত্যা মামলার আসামি।
পত্রিকার খবর আর বিভিন্ন থানার রেকর্ড থেকে এ রকম ঘটনার উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। শিশু হত্যার পরও তার অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা ঘটছে। এমনিতে দেশে কয়েক মাস ধরে খুনের ঘটনা বাড়ায় মানুষের মনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। তার ওপর মৃত একটা মানুষের দেহের এই ভয়াবহ পরিণতির কথা মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলে। সব মিলিয়ে সময়ের চাকার গতি যেন সভ্যতার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
গত কয়েক মাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিসংখ্যান খুব একটা সুখকর নয়। শুধু শিশুহত্যার পরিসংখ্যান আমাদের আতঙ্কিত করে। এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৩ মাসে ১২৫টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে বলে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। এই ৩ মাসে ৯১টি মেয়েশিশু ও ১৬টি ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরও ২২৮টি শিশু। পত্রিকার ভেতরের পাতায় খুব ছোট করে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এটিই আমাদের মন বড় আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এমন প্রবণতা আমাদের কোন অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বুঝতে পারছি না।
একটি মৃত্যু একজন মায়ের জন্য কতটুকু বিপর্যয় নিয়ে আসে, তা আমরা ভেবে দেখি না। গণমাধ্যমে খবর দেখে আমরা কিছুক্ষণের জন্য হাহুতাশ করে থাকি। কিন্তু দুই দিন পরেই আমাদের চোখের সামনে নতুন কোনো দুর্ঘটনা বা নতুন কোনো অপঘাতের ঘটনা উঠে আসে। ভুলে যাই আগের দিনের ঘটনা। এ রকম কতশত মায়ের চোখের জলে ভাসছে দেশটা।
অভিভাবক তাঁর সন্তানের জন্য, সন্তান তার বাবার জন্য সব সময় একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকছেন। কিন্তু কেন? এই দেশে তো কোনো গৃহযুদ্ধ চলছে না। দেশ তো অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধেও লিপ্ত নয়। তবু কেন প্রায় প্রতিদিন খুনের খবর পড়ে আমাদের দিন শুরু হয়? সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে নয়, পারিবারিক কলহ, দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির লোভ থেকেই খুন হচ্ছে বেশি। মাঝেমধ্যে দলীয় কোন্দলেও খুন হচ্ছে। ৭ অক্টোবর রাঙ্গুনিয়ার যুবলীগ নেতা মনজুর হোসেনকে মুখোশ পরা কয়েকজন লোক এসে কুপিয়ে খুন করে চলে গেল।
মানুষ খুন করা এতটা সহজ হয়ে গেল চড়থাপ্পড়ের মতো! সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ জন খুন হচ্ছেন। বন্ধু বন্ধুকে, সন্তান বাবাকে, স্বামী স্ত্রীকে, ভাই ভাইকে, মা তার নিজের সন্তানকে খুন করছেন। এসব খুনের পেছনে ব্যক্তিস্বার্থ ও দ্বন্দ্ব কাজ করে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ খুন হচ্ছে একেবারে কোনো রকম স্বার্থের মধ্যে না থেকেও। গত ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাইতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে ১৫ বছরের কিশোর রায়হান হোসেন মারা গেল। তার মা খালেদা আক্তারসহ স্বজনেরা দাবি করেছেন, রায়হান কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। দরিদ্র পরিবারের সন্তান রায়হান সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করতে মাত্র চার হাজার টাকা বেতনে চাকরি করত।
একটি মৃত্যু একজন মায়ের জন্য কতটুকু বিপর্যয় নিয়ে আসে, তা আমরা ভেবে দেখি না। গণমাধ্যমে খবর দেখে আমরা কিছুক্ষণের জন্য হাহুতাশ করে থাকি। কিন্তু দুই দিন পরেই আমাদের চোখের সামনে নতুন কোনো দুর্ঘটনা বা নতুন কোনো অপঘাতের ঘটনা উঠে আসে। ভুলে যাই আগের দিনের ঘটনা। এ রকম কতশত মায়ের চোখের জলে ভাসছে দেশটা। রায়হান যেমন একটি পরিবারের স্বপ্নকে মাটিতে চাপা দিয়ে চলে গেল, তেমনি পারিবারিক কলহের কারণে যেসব খুন হয়, সেগুলোও পুরো পরিবার আর তার আত্মীয়স্বজনকে বিরাট একটা ট্রমার মধ্যে ফেলে দেয়।
একটা খুন, তার রেশ থেকে যায় বহু বছর। সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপরও এসব পারিবারিক খুনের ঘটনাকে অনেকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে গ্রাহ্য করেন না। বলতে চান, একটা মানুষকে তার পরিবারের মানুষেরা খুন করেছে, তাতে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয় না। মানুষ রাগের বশে, লোভের বশে বা নানা কারণে হঠাৎ এ রকম খুন করে ফেলতে পারে। সমাজের প্রতিটি পরিবারে এ রকম ঘটনা সচরাচর হয় না। কথাটা ঠিক। কিন্তু পরিসংখ্যানে ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সমাজ ভাঙনের পূর্বাভাস দেয়।
যে পারিবারিক কলহ শেষ পর্যন্ত মানুষকে তার স্বজন হত্যায় প্ররোচিত করে, সে মানুষ তো একটা সমাজেরই অংশ। তার মনটাই তো শেষ পর্যন্ত একটা সমাজমনস্কতা তৈরি করে। মানুষের এই বিধ্বংসী প্রবণতা কেন বাড়ছে? তা ব্যাখ্যা হয়তো সমাজবিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন। মানুষের মন থেকে ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা যেন কমে যাচ্ছে। ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। আর এসবের কারণে নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে শুরু করছে। নিরাপত্তাহীনতাবোধ মানুষকে ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক ও সমাজবিচ্ছিন্ন করে তুলছে। তার ওপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে ক্রমে অস্থির করে তুলছে।
কিন্তু অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা কি মানুষের অপরাধপ্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়? মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণহীন করে দেয়। তার বিবেকের জানালাটাকে রুদ্ধ করে দেয়। সন্তানদের হাতে নিহত হাসান আলীর পুত্রবধূ আনারকলি গ্রেপ্তারের পর বলেছিল, ‘আবেগের বশে কাজ করেছি, বিবেকটা কাজ করে নাই তখন।’ আনারকলির এ কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভালোবাসার স্বামীকে তিনি পিতৃহত্যায় সহযোগিতা করেছেন বলে স্বীকার করে এ কথা বলেছেন তিনি। যেন পুরো চলমান সময়ের, বর্তমান সমাজের অন্তরের কথাটাই প্রতিধ্বনিত করলেন। সমাজটা যেন অন্ধ আবেগেই চলছে, বিবেকটা কাজ করছে না।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক