বেকারদের জন্য নতুন চাকরি তৈরির দায়িত্ব কার

চাকরির বাজারে হাহাকার চলছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালকের ১৫ পদের বিপরীতে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৭২ হাজার ৪৫ জন। ৪৫ হাজার সহকারী শিক্ষক পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ১৩ লাখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ৮১টি পদের বিপরীতে আবেদন ছিল প্রায় ৩ লাখ। বেকারত্বের এমন বিপর্যয়কারী পরিস্থিতি নিয়ে সরকার দৃশ্যত নির্বিকার।

দেশের সবচেয়ে বড় চাকরির বিজ্ঞাপনের সাইট বিডিজবস-এর তথ্যমতে, তৈরি পোশাক খাতের কর্মসংস্থানে আগস্ট ২০২২-এর পর নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে; কমছে চাকরির বিজ্ঞপ্তি, শূন্য পদ এবং বিজ্ঞাপন দানকারী কোম্পানির সংখ্যাও।

২০২২ সালের শেষ চার মাসে, পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ ও শূন্য পদ কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। এ সময় কর্মী খোঁজা কোম্পানির সংখ্যা কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২২ সময়কালে বিডিজবস সাইটে তৈরি পোশাক খাতের ১ হাজার ২৫৫টি কোম্পানি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। মোট চাকরির পদসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৪৮, শূন্য পদ ৫ হাজার ৩৯৩। যদিও ২০২১ সালের শেষ চার মাসে বিডিজবস সাইটে তৈরি পোশাক খাতের ১ হাজার ৩৫৮টি কোম্পানি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাকরির পদসংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২০০, শূন্য পদ ছিল ৬ হাজার ৮১০।

বিডিজবসের চাকরির বিজ্ঞাপন কমার হার, পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ কমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। টানা ১৩ মাস ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর গত সেপ্টেম্বরে দেশে রপ্তানি আয় কমে। পাশাপাশি আছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট, ডলারের উচ্চমূল্যে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, এলসি বন্ধ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সংকট। তবে সরকার সবকিছুই যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা থাকলেও উন্নত বিশ্বে করপোরেট লভ্যাংশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার রেকর্ড পর্যায়ে কম। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতসহ সার্বিক বেকারত্ব পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক সমস্যার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ডলার রিজার্ভ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা, ঋণপত্র সংকটও দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। রয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দা, সরকারের উচ্চ ঋণ ও খোলা বাজারে ডলার বিক্রয়জনিত তারল্য সংকট, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঠকিয়ে ঋণ খেলাপিদের একতরফা সুবিধা দানের কাঠামোগত সমস্যা।

বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৬০ লাখ উচ্চ শিক্ষিত বেকার, সঙ্গে শুরু হয়েছে স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমবাজারের বেকারত্ব। একদিকে কর্ম তৈরির সরকারি কৌশল নেই, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও ডলার-সংকট, বেসরকারি ঋণ ও বিনিয়োগ খাতে পাচার এবং কেলেঙ্কারিজনিত মন্দার থাবা। দক্ষতা তৈরিতে শিল্পে ও শিক্ষালয়ে ট্রেনিং পরিকল্পনা নেই। দেশের বেকারত্বের কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস ও চাকরি তৈরির মাসিক ড্যাশবোর্ডও নেই। ফলে সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে।

বাংলাদেশের চাকরি বাজারে আগে থেকেই দক্ষ জনবলপ্রাপ্তির সমস্যা রয়েছে। বাজার চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার কোর্স-কারিকুলামের সংযোগ স্থাপিত হয়নি বলে এক পদের বিপরীতে শত শত আবেদনকারী থাকেন, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ রিসোর্স পাওয়া যায় না।

বরং আবেদনপত্র নিরীক্ষণে অপচয় হয় সময় ও অর্থ। তৈরি পোশাক শিল্পসহ প্রায় সব শিল্পই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অটোমেশন বাড়ছে, নিম্ন দক্ষতার চাকরি কমছে, ঘটনাটা এখনই ঘটতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় নতুন শিল্প চাহিদার দক্ষতার ভিত্তিতে একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রির যৌথ সমন্বয়ে দ্রুত দক্ষ শ্রমিক তৈরির রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি শ্রমিকপ্রতি মাথাপিছু রেমিট্যান্সও বাড়বে। সময়ের সঙ্গে কারিগরি দক্ষ চাকরি বাড়ছে, অদক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষ চাকরি কমছে। দেশে ও দেশের বাইরে এই পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছে বিদেশিরা। অভ্যন্তরীণ শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিক—তিন ক্ষেত্রেই দক্ষতার চাহিদা প্রযোজ্য। বিশ্বে যুদ্ধ ও মন্দা না হলেও শ্রমবাজারে দক্ষতার এই রূপান্তর ঘটতেই থাকবে।

দেশের প্রায় ৮৫ থেকে ৮৯ শতাংশ শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক। ফলে চাকরি বাড়াতে বেসরকারি খাতে সত্যিকার বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার, এমন স্বচ্ছ উদ্যোগ যেখানে বিনিয়োগের নামে ঋণ নিয়ে সেটা পাচার কিংবা ভোগে ব্যয় হবে না। সরকারকে ক্ষুদ্র, এসএমই ও বৃহৎ ব্যবসা ও শিল্পের ভালো ব্যবসায়ীর ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে, যাঁরা ঋণ নিয়ে কিস্তি ফেরত দেন ও ব্যবসা করেন। তথ্যশালার আলোকে ক্রেডিট রেটিং-ভিত্তিক আধুনিক ঋণদান ব্যবস্থা দরকার। ব্যাংক ঋণ দানের ডিজিটাল ফিনটেক সমাধান ও আর্থিক তথ্যনির্ভর নতুন ডিজিটাল কৌশল বের করাও জরুরি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, ক্ষুদ্র বা ব্যাস্টিক অর্থনীতির চাকরি বাঁচানো মন্দাকবলিত অর্থনীতির বড় কাজ। প্রশাসনের দুর্নীতি ও সরকারের অপখরচের লাগাম টেনে ধরে সামাজিক নিরাপত্তা ও চাকরি বাড়ানোর উদ্যোগ চাই।

বর্তমানে আমানত প্রবাহ কম ও তারল্য সংকট পরিস্থিতিতে ছয়-নয় সুদের হার কাজ করছে না বলে এটা উঠিয়ে, ব্যাংক ঋণ পাচার ও গায়েবের দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করে অর্থবহ শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। কর্মী ছাঁটাই না করার শর্তে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে হবে এবং খেলাপি ঋণ না করা ব্যবসা ও শিল্প মালিকদের সহজ শর্তের ঋণ প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থাৎ বর্ধিত বেকারত্বের ধারা থামাতে মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য ফ্লেক্সিবল করতে হবে।কোম্পানি গুলোতে কর্মরত জনসম্পদকে নতুন মেশিনে, রোবোটিক অপারেশন পরিচালনায় দক্ষ করার জন্য ম্যাসিভ প্রোগ্রাম দরকার। আধুনিক অটোমেশন করা উৎপাদন পরিবেশের সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকদের দক্ষতা অর্জনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা, ট্রেনিং বাজেট ও ট্রেনিং জরুরি।

পাশাপাশি বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে ধীরে ধীরে বিদেশি শ্রমিক কমিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে, দেশীয় শ্রমিক নিয়োগে গুরুত্বারোপ করা চাই। অবশ্যই নতুন কর্মদক্ষতার মানবসম্পদ বিদেশ থেকে আনতে হবে এবং সেখানেও দক্ষতা হস্তান্তরের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার মোট শ্রমবাজারের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশের নিয়োগদাতা। বর্ধিত বেকারত্বের সমস্যার মুখে সরকারি শূন্য পদে নিয়োগের হার বৃদ্ধি করা দরকার। সেবা খাতে মাথাপিছু নিয়োগের কর্মসংস্থান বান্ধব বাজেটীয় কৌশল দরকার। মাথাপিছু শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা কর্মী নিয়োগ বাড়িয়ে সরকারি কর্মসংস্থানকে অন্তত ৫ শতাংশে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। তবে মেধাভিত্তিক নিয়োগ না দেওয়ায়, প্রশাসনে অদক্ষ ও অযোগ্য কর্মচারী ও কর্মকর্তার ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে!

সরকারি নিয়োগে তরুণদের দুটি দাবি উল্লেখযোগ্য। কোটার দৌরাত্ম্য ও বেকারদের কাছে চাওয়া আবেদন ফি’র অন্যায্যতা। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে নারী ও পোষ্য কোটা মিলে ছিল ৮০ শতাংশ। ২০ শতাংশ পুরুষ কোটার পরে মেধা কোটার কার্যকর হার শূন্য। এমন সমস্যা রেল, ডাক বিভাগসহ আরও কিছু খাতে। রাষ্ট্রীয় নিয়োগের নামে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগের এমন সাক্ষাৎ প্রতারণা অর্থহীন। নারী ও পোষ্য কোটার ৮০ শতাংশের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নাটক সাজানোর অর্থ হচ্ছে, লাখ লাখ বেকার চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে আবেদন ফি নেওয়ার ব্যবসা জারি রাখা। এই দুর্বৃত্তপনা বন্ধ হোক! চাকরিতে কয়েক দশকের নারী অগ্রাধিকার চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘নারীরা এখন শিক্ষায় ও চাকরিতে এমনিতেই বেশ এগিয়ে আছে। তাই তাঁদের ২০ শতাংশের বেশি কোটা দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। প্রাথমিকের শিক্ষকেরা এখন ভালো বেতন পান। তাঁদের সন্তানদের জন্য পোষ্য কোটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই’ (২৯ ডিসেম্বর ২০২২ প্রথম আলো)। অগ্রহণযোগ্য কোটা বাতিল, সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি নেওয়ার ব্যবসা বন্ধ, সীমিত হলেও চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটা চালু, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নম্বর প্রকাশসহ চাকরি প্রার্থীদের ন্যায্য দাবি মানা দরকার।

বেকারত্বের মিছিলে নতুন সমস্যা, তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিক নিয়োগ কমা। ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প মোট ৩ হাজার ৫০০টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছে, নারী শ্রমিকদের হার ৫৮ শতাংশ ও পুরুষদের ৪২ শতাংশ। অথচ একটা সময় নারী শ্রমিক প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল। করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, মূল্যস্ফীতিতে শহরে বসবাস কঠিন হয়ে পড়েছে, গরিব মানুষ শহর ছাড়ছে বলে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিক সরবরাহ কমছে। আছে কারিগরি সমস্যা। রোবট, কাটিং মেশিন, লেজার মেশিন, অটোমেটিক যন্ত্রপাতি পরিচালনায় নারীদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া হয় না বলে, নারীর তুলনায় পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের হার বাড়ছে। কমবয়সী নারীর প্রখর আলো, গরম, মাইক্রো ফাইবারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ শ্রমঘণ্টার শ্রমঘন কাজে নারীর দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ক্ষতি বাড়ছে বলে নারীরা পোশাক শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রান্তিক অর্থনীতির বর্ধিত নারী বেকারত্ব দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে শোচনীয় করবে। এসব কাঠামোগত সমস্যার সমাধান দরকার।

বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৬০ লাখ উচ্চ শিক্ষিত বেকার, সঙ্গে শুরু হয়েছে স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমবাজারের বেকারত্ব। একদিকে কর্ম তৈরির সরকারি কৌশল নেই, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও ডলার-সংকট, বেসরকারি ঋণ ও বিনিয়োগ খাতে পাচার এবং কেলেঙ্কারিজনিত মন্দার থাবা। দক্ষতা তৈরিতে শিল্পে ও শিক্ষালয়ে ট্রেনিং পরিকল্পনা নেই। দেশের বেকারত্বের কেন্দ্রীয় ডেটাবেইস ও চাকরি তৈরির মাসিক ড্যাশবোর্ডও নেই। ফলে সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে।

বেকারত্বের সরকারি সংখ্যা অযৌক্তিক, এই দিয়ে ফলপ্রসূ কৌশল তৈরিও অসম্ভব। বেকারত্বের সরকারি সংখ্যাও রেকর্ড করেছে। মধ্যবিত্ত দেশগুলোর একটা বড় বৈশিষ্ট্য বেকার ভাতা, বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। জীবিকা বাঁচাতে না পারলে অর্থনীতি কীভাবে বাঁচবে, এই প্রশ্নের উত্তর কাঠামোগতভাবে খুঁজতে হবে সরকারকে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য।
    ইমেইল: [email protected]