গণ অধিকার পরিষদ কার ‘ফাঁদে’ পড়েছে

গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, আরেক পক্ষ হচ্ছে সদস্যসচিব নুরুল হক

কিছুদিন ধরেই গণ অধিকার পরিষদের অভ্যন্তরে নানা ধরনের ক্ষোভ, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। সম্প্রতি ইনসাফ কায়েম কমিটি নামে একটি সংগঠন রাজনীতির মাঠে নামার পর এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়।

মূলত ইনসাফ কায়েম কমিটির কার্যক্রমে যোগ দেওয়াকে ঘিরেই গণ অধিকার পরিষদ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। একদিকে আছেন দলটি আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, আরেক পক্ষ হচ্ছে সদস্যসচিব নুরুল হক নুর ও রাশেদ খানের নেতৃত্বে একাংশ। আরেকাংশ হচ্ছে বিভিন্ন সময় দলে যোগ দেওয়া সুশীল রাজনীতিবিদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শুরু থেকেই দলটি সঠিক পরামর্শ ও নির্দেশনা অভাবে ভুগছে। যে কারণে রাজনীতির মাঠে নিজস্ব অবস্থান তৈরির আগেই হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নুরুল হক ও রাশেদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে মাঠে রাজনীতি করতে হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে সরকার একপর্যায়ে সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কার করতে বাধ্য হয়। নুরুল হক ডাকসুর সহসভাপতি পদেও নির্বাচিত হন। এ সাফল্যই নুরুল হক ও রাশেদদের রাজনীতির মাঠে টেনে নিয়ে আসে। গঠন করা হয় গণ অধিকার পরিষদ।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল তরুণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না। মূলত, রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতাই দলটিকে ইনসাফ কায়েম কমিটির ফাঁদে ফেলেছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় তিন ধারায় বিভক্ত দলটি আর শক্তভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

প্রথমত, দলটির এখনো নিবন্ধন হয়নি। নিবন্ধন দেওয়ার নাম করে তিন পক্ষকেই সরকার কাছে টানার চেষ্টা করবে। গণ অধিকার পরিষদের বিভাজন নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেবে। তিন পক্ষের সামনেই নানা ধরনের মুলা ঝোলানো হবে। এতে গণ অধিকার পরিষদের সরকারবিরোধিতা, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনসহ নানা দাবি থেকে সরে আসতে হতে পারে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা দিকে যেতে পারে দলটি।

গত জানুয়ারি পর্যন্ত গণ অধিকার পরিষদ ভালো অবস্থানেই ছিল। মোটামুটি একটি অবস্থান রেখেই রাজনীতির করে যাচ্ছিল। ইসরায়েলের কথিত এক গোয়েন্দার সঙ্গে নুরুল হকের বৈঠক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

নুরুল হক সব সময়ই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে গণ অধিকার পরিষদের বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে, বৈঠকটি হয়েছিল। যদি আসলেই ইসরায়েলের কথিত ওই গোয়েন্দার সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক হয়েই থাকে, তবে নুরুল হক এটা স্বীকার করলেই পারতেন। এতে ক্ষতির পরিমাণ কম হতো। কাদের পরামর্শে তিনি চেপে গেলেন, তা বোধগম্য নয়। সম্ভবত এই ঘটনার পর থেকেই ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হককে লক্ষ্য করে পরিকল্পনা সাজানো হয়।

গণ অধিকার পরিষদের দ্বন্দ্ব ও শওকত মাহমুদের বহিষ্কারের ঘটনায় মনে হচ্ছে, ইনসাফ কায়েম কমিটির কাজই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানো। এ কাজে তারা গণ অধিকার পরিষদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছে। বিএনপির ক্ষেত্রে কতটা সফল, তা সময়ই বলে দেবে।

তবে দলটির প্রথম ভুল ছিল ড. রেজা কিবরিয়াকে দলের নেতৃত্বে আনা; বরং নুরুল হক নিজেই দলের প্রধান হতে পারতেন। বিভিন্ন সময় সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও পেশাদারদের না নিয়ে একদম রাজনীতির মাঠ থেকে উঠে আসা তরুণদের অংশগ্রহণে দল গঠন করা উচিত ছিল। ড. রেজা কিবরিয়ার মতো অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যাঁরা দলে নেওয়ার পরামর্শ নুরুল হকদের দিয়েছেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল সম্ভবত নবগঠিত এই দলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা। নিজেদের সুবিধার্থে বিভিন্ন সময় গণ অধিকার পরিষদকে ব্যবহার করা।

বস্তুত, বাইরে থেকে ধরে আনা নেতৃত্ব দিয়ে দল পরিচালনা করা কঠিন। উল্লেখ্য, ড. রেজা কিবরিয়া গণ অধিকার পরিষদের দলীয় অনুষ্ঠানে নিয়মিত থাকতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ইনসাফ কায়েম কমিটির বিভিন্ন বৈঠকে নিয়মিত অংশ নিতেন। এটা নিয়ে দলের মধ্যেও অসন্তোষ ছিল। গণ অধিকার পরিষদে অসন্তোষ আরও নানা বিষয়েই আছে। যেমন দলটির তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়া ও আয়–ব্যয় নিয়ে নানা ধরনের কথা আছে।

দুর্বল বিষয়গুলো চিহ্নিত করে খুব কৌশলে প্রথমে গণ অধিকার পরিষদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। বিভাজন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছার পর দলটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামে ইনসাফ কায়েম কমিটি। আপাতদৃষ্টে মনে হবে, ইনসাফ কায়েম কমিটি সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের দ্বন্দ্ব সব সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে।

যেমন ইনসাফ কায়েম কমিটির আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ। শোনা যাচ্ছে, বিএনপির সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে আরও কয়েকজন উকিল আবদুস সাত্তারের মতো দল ত্যাগ করে ভিন্ন নামে ইনসাফ কায়েম কমিটির জাতীয় সরকার বাস্তবায়নের আন্দোলনে শরিক হতে পারেন। বিএনপির জোট থেকে কিছু দল বের হয়ে আলাদা জোট করেছে। এরা যদি পরবর্তী সময়ে ইনসাফ কায়েম কমিটির কর্মসূচিতে শরিক হয়, তবে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। আর ইনসাফ কায়েম কমিটির সমাবেশে যাওয়া নিয়ে গণ অধিকার পরিষদ তো এখন তিন ভাগেই বিভক্ত। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সবাই তো সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে।

আরও পড়ুন

তাহলে এটা নিয়ে বিভিন্ন দল, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে ইনসাফ কায়েম কমিটির বিরোধের জায়গাটা কোথায়? বিরোধের জায়গা হচ্ছে ইনসাফ কায়েম কমিটির ওপর সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা দলগুলো আস্থা রাখতে পারছে না। অনেকেই মনে করছেন, সরকারবিরোধিতার ভান করে আন্দোলনে ফাটল ধরাতে চাইছে ইনসাফ কায়েম কমিটি।

গণ অধিকার পরিষদের দ্বন্দ্ব ও শওকত মাহমুদের বহিষ্কারের ঘটনায় মনে হচ্ছে, ইনসাফ কায়েম কমিটির কাজই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানো। এ কাজে তারা গণ অধিকার পরিষদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছে। বিএনপির ক্ষেত্রে কতটা সফল, তা সময়ই বলে দেবে।

তবে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপি ও গণ অধিকার পরিষদ উভয়কেই সতর্ক হতে হবে। দলের মধ্যে যথাসম্ভব স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। ভুল পরামর্শকদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দুই দলকেই। সম্ভবত অরাজনৈতিক ও অদূরদর্শী একদল পরামর্শকের ফাঁদে পড়েছে দুই দলই। এদিক–সেদিক দৌড়াদৌড়ি না করে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরই নিতে হবে তাদের।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক