লেখালেখির ওপর ঝুলছে খাঁড়া

আমি মাঝেমধ্যে পত্রিকায় লিখি, কলাম বা নিবন্ধ। কেউ পড়েন, কেউ পড়েন না। কেউ কেউ পড়ে মতামত বা পরামর্শ দেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আবার অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভাই, এসব কী লেখেন? আপনার লেখার ধার কমে গেছে! লাইন পেয়ে গেছেন নাকি?’ ইত্যাদি। আমি আর কী জবাব দেব? আত্মরক্ষার্থে বলি, ‘যা লিখি না বা লিখতে পারি না, সেটা আপনি লিখছেন না কেন?’

একদল মানুষ আছেন, যাঁরা পত্রিকার পাতায় বিপ্লব বমি করতে চান। সম্পাদকীয় নীতির কারণে পারেন না। পত্রিকায় যা খুশি লেখা যায় না। মেঠো ভাষণে যথেচ্ছ বলা যায়, লিফলেটে যা খুশি লেখা যায়। ইদানীং ফেসবুক হয়েছে ইচ্ছাপূরণের জমি। সেখানে অবাধ স্বাধীনতা। সেখানে একাডেমিক আলোচনা, জ্ঞান বিতরণ, প্রেম নিবেদন, কাব্যচর্চা, গিবত—সবই চলে। ছাপা পত্রিকায় এসব চলে না।

মঙ্গলবার সকালে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল। জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, দেশে এখন ১ হাজার ১৪১টি পত্রিকা আছে। তার মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ৫০৯টি। সংখ্যা দেখে বোঝা যায়, দেশে পত্রিকার বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ছাড়া আছে অনেক অনলাইন নিউজ চ্যানেল ও পোর্টাল।

অনেকেই অনুযোগ করেন, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সরকারের কর্তারা অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই নালিশ ভিত্তিহীন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে এত পত্রিকা বেরোয় কী করে!

মন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে আরেকটি তথ্য আছে। ‘জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়, এমন কার্যক্রম পরিচালনাকারী ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ১৯১টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের ডোমেইন বরাদ্দ বাতিল করাসহ লিংক বন্ধ করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে’ (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, ‘জনমনে বিভ্রান্তি’ ছড়ানো নিয়ে। এটাকে কোন মানদণ্ডে সংজ্ঞায়িত করবেন। সরকারের গোয়েন্দা, তাদের কম জানাবোঝা সোর্স, নাকি ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’। আমরা দেখি, সরকার বদল হলে অনেক কিছুর সংজ্ঞা বদলে যায়। তবে সব সরকারের আমলে একটা বিষয়ে ঐকমত্য আছে—সবাই ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ চায়। কোনটা ‘গঠনমূলক’, সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। তবে সবাই জিন্দাবাদ শুনতে পছন্দ করে। মুর্দাবাদের দিন শেষ।

আমাদের সামনে দুটি খাঁড়া ঝুলছে। একটি হলো, ‘কটূক্তি’ করা যাবে না। কারণ, তাতে মানী লোকের মান নষ্ট হয়, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। অন্যটি হলো, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত দেওয়া যাবে না। আমরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গালাগাল করতে দেখি। তবে সব গালাগাল অপরাধ নয়। এখানে ক্ষমতাসীনদের ইমিউনিটি আছে। অন্যদের ধরে–বেঁধে আনা হয়।

প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক থানার দারোগা। তিনি যদি মনে করেন ব্যাটা কটূক্তি করেছে, তাহলে তার হাজতবাস নিশ্চিত। জজকোর্ট-হাইকোর্ট পেরিয়ে মামলা জিতে জামিন বা খালাস না পাওয়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। প্রবীর শিকদারের কথা আমাদের মনে আছে। এক ক্ষমতাধর লোক তাঁর কী হালত করেছিলেন? আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত? কার অনুভূতিতে কখন যে আঘাত লাগে, তা ভেবে তটস্থ থাকতে হয়। একটা উদাহরণ দিই।

আমি মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে একটা বই লিখছি। ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে টাইম ম্যাগাজিনে মাওলানাকে নিয়ে ড্যান কগিনের একটি কভার স্টোরি ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল প্রফেট অব ভায়োলেন্স। আমি এর তরজমা করলাম। প্রকাশক বললেন, ‘কী দরকার। বোঝেনই তো! মেলায় স্টলই দিতে পারব না।’ আমিও বুঝে নিলাম। কে জানে, এ নিয়ে আবার কার অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়! এখন তো অনুভূতিওয়ালাদের রমরমা!

ধরুন, একই বিষয়ে আমার অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। কিন্তু আপনার লাগে। পুলিশ আপনার অভিযোগটাই গ্রহণ করবে। আমার যুক্তি বা কোন প্রেক্ষাপটে আমি এটা বলেছি, সেটা গ্রাহ্য করবে না।

তাহলে আমরা কী করব? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? নাকি নিরাপদ বিষয়গুলো নেড়েচেড়ে খাব? এই যেমন ফুল, পাখি, চাঁদ, তুমি, আমি—এই সব পদ্য কিংবা গদ্য। অথবা সরকারি ক্রোড়পত্রের জন্য লেখা। ওরা টাকাপয়সাও নাকি ভালো দেয়। কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগার ঝুঁকি নেই।

কেউ কেউ এমনও বলেন, এ অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। সাহস করে লিখতে হবে। মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে আবার কিসের বুদ্ধিজীবী! মুশকিল হলো, আপনি যখন বিপদে পড়বেন, তখন এঁদের দেখা পাবেন না। হয়তো টেলিফোনে যোগাযোগ করে ২০-২৫ জনের একটা বিবৃতি জোগাড় করে পত্রিকায় ছাপানো গেল। তাঁরা অমুককে ‘হয়রানি’র বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তো তাতে কী হবে? এতে হয়রানি কমবে? কর্তারা এসব থোড়াই কেয়ার করেন।

মুশকিল হলো জোলো বিষয়গুলো নিয়ে লিখলে কেউ পড়েন না। সরকারি সংস্থা বা ব্যক্তি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা খরচ করে ক্রোড়পত্র ছাপে। সেখানে বন্দনাগীতি বা প্রশস্তিগাথা লেখেন অনেক রাজকবি বা মার্সেনারি লেখক। কজন তা পড়েন? একটা জরিপ করে দেখলে মন্দ হয় না।

পত্রিকায় কেমন সংবাদ থাকা উচিত, কী বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা লেখা দরকার, এসব নিয়ে পাঠকের চাওয়া-পাওয়া আছে। বিশেষ ধরনের খবর বা প্রবন্ধের সামাজিক চাহিদা আছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে হয়। সাধারণ মানুষ বা পাঠকের চাহিদাকে এড়িয়ে গিয়ে বা উপেক্ষা করে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার লোকের অভাব নেই। সব যুগেই এটা দেখা গেছে। তারপরও কথা থাকে।

আমরা জানি, এ দেশে দলীয় সংবাদপত্রের মান এবং চাহিদা দুটিই কম। সরকারে থেকেও দলীয় পত্রিকা বাজারে চালানো কঠিন। দলের লোকেরাও দলকানা পত্রিকা মন থেকে চান না। লুকিয়ে হলেও ভিন্নমতের পত্রিকা পড়েন। এ দেশে দলীয় কাগজ দৈনিক দেশ কিংবা বাংলার বাণী—দুটির একই পরিণতি হয়েছে। পাঠক গ্রহণ করেননি। ফলে ওগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

হাত-পা বেঁধে দিয়ে পানিতে ছুড়ে দিলে সাঁতার কাটা যায় না। আইনের বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে আর ক্ষমতাবানদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মতামত প্রকাশের জায়গাটা যে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, পত্রিকার পাতা খুললেই এটা বোঝা যায়। তবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মতামত চেপে রাখা যায় না। বিদেশি গণমাধ্যমে অনেক কিছুই প্রচার পায়। এখন তো অনলাইনেই সব দেখা যায়। কত ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

তদুপরি আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফেসবুক। অনেক সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ না পেলে কিংবা গণমাধ্যম সেটা চেপে গেলেও ফেসবুকের কল্যাণে আমরা তা চটজলদি পেয়ে যাই। এটা অনেক সময় কর্তৃপক্ষের অস্বস্তি ও উষ্মার কারণ হয়। সেটা সামাল দিতে অনেক কারসাজি করতে হয়। তার একটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অনেক সরকারি সাংবাদিকও এর পক্ষে আছেন। তারপরও যদি দরকার হয়, কর্তৃপক্ষ উত্তর কোরিয়ায় একটা ডেলিগেশন পাঠাতে পারে দেখতে, তারা কীভাবে নাগরিকদের বশে রাখছে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক