ঋণখেলাপিদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনে দ্বিধা কেন

১৯৯৮ সালে খেলাপি ঋণের সংকট সমাধানে ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) ‘প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা’য় তিনি প্রথম প্রস্তাবটি দেন।

১৯৯৯ সালে ‘দ্বিতীয় নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা’য় একই দাবি উত্থাপন করেছিলেন আরেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে তাঁদের চেয়ে বেশি আর কে জানতেন? তাঁদের সেই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি তখনকার হাসিনা সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ করার ১৫ মাসের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এলেও খেলাপি ঋণ সমস্যার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি; বরং এখন আগের মতো খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার তৎপরতা আর না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত শ্রেণিভুক্ত ঋণের অনুপাত বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে এই অনুপাত ৪০ শতাংশ অতিক্রম করলেও অবাক হওয়ার নয়। তবু সরকারের টনক নড়ছে না কেন, সেটিই প্রশ্ন।

আরও পড়ুন

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যে টাস্কফোর্স গঠন করেছেন, সেটি সফল হতে হলে ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে, নয়তো ব্যর্থতা অনিবার্য। আমার প্রস্তাব, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর শ্রেণিভুক্ত ঋণের যে হিসাব প্রকাশ করে, তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন আদালতে মামলার বিষয়বস্তু হিসেবে কত খেলাপি ঋণ আটকে রয়েছে, তার সর্বশেষ হিসাব এবং কত খেলাপি ঋণ ‘রাইট–অফ’ (অবলোপন) করা হয়েছে তারও সর্বশেষ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হোক।

স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিল ব্যাংক খাত। ফলে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। দেশে ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হাসিনার খেয়ালখুশি সিদ্ধান্তে তাঁর আত্মীয়স্বজন, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের পুঁজি লুণ্ঠনের অবিশ্বাস্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এতগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

এই ১১ ব্যাংকের মধ্যে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের ৭টি ব্যাংক—ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে। একজন ব্যক্তিকে সাতটি ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে দেওয়ার দ্বিতীয় নজির বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এস আলম তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটি ব্যাংক থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা লুটে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী লুটে নিয়েছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে। হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমি বহু বছর ধরে বলে আসছি যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত শ্রেণিবদ্ধ ঋণের হিসাব জনগণের সঙ্গে ‘ভয়াবহ প্রতারণা’। কারণ, খেলাপি ঋণের তিনটি প্রধান ক্যাটাগরিতে কারিগরি কারণে এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। এ তিনটি ক্যাটাগরি হলো :

হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘শুভংকরের নিকৃষ্টতম ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা। এই লুণ্ঠিত অর্থের সিংহভাগই ব্যাংকের অর্থ, যার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার করা খেলাপি ঋণের কোনো অংশই ব্যাংকে ফেরত আসবে না।

১. অর্থঋণ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যেসব খেলাপি ঋণের মামলা বছরের পর বছর ‘বিচারাধীন মামলা’ হিসেবে ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক শক্তি এবং বিচার বিভাগের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘শ্রেণিবদ্ধ ঋণের’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

২. যেসব মন্দ ঋণ (খেলাপি ঋণ) পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো হয়ে গেছে, সেগুলোকে ব্যাংকগুলো চাইলে এবং তাদের সক্ষমতা থাকলে ‘রাইট–অফ’ বা অবলোপন করতে পারে। সক্ষমতার প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে রাইট–অফ করা খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং করতে হয়। প্রভিশনিং করার মানে হলো রাইট-অফ করা মন্দ ঋণের সমপরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ হিসেবে দেওয়া যায় না। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের সব ব্যাংক থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা রাইট-অফ করা হয়েছে। অতএব, এই ৭০ হাজার কোটি টাকাকেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণের সঙ্গে যোগ করতেই হবে।

৩. তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো আইনানুগভাবে যতবার ঋণ রিশিডিউলিং (পুনঃ তফসিলীকরণ) করা যায়, তার চেয়ে বেশিবার রিশিডিউল করে কোনো ঋণকে নিয়মিত দেখানো কিংবা নতুন ঋণ অনুমোদন করে পুরোনো খেলাপি ঋণকে সেই নতুন ঋণের মধ্যে অ্যাডজাস্ট করে দেখানো। এ দেশের প্রায় সব ব্যাংক এই অবৈধ উপায় ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করত বলে ওয়াকিবহাল মহল অভিযোগ করে থাকে।

আরও পড়ুন

এর মানে খেলাপি ঋণ সংকটের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো চিত্র থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ। গভর্নর বলেছেন, পাকিস্তানের চেয়েও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সংকট বেশি গুরুতর। আরও গুরুতর হলো বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

হাসিনা তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প এবং ব্যাংকিং খাত থেকে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তার ভয়াবহ কাহিনি তার পতনের পর উন্মোচিত হতে শুরু করেছে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে এই দুই ঋণের স্থিতির পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।

হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতিবছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘শুভংকরের নিকৃষ্টতম ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা। এই লুণ্ঠিত অর্থের সিংহভাগই ব্যাংকের অর্থ, যার বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার করা খেলাপি ঋণের কোনো অংশই ব্যাংকে ফেরত আসবে না।

এর মানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সামান্য পরিমাণে আদায় করতে হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। দেশের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যার কোনো কূলকিনারা পেতে হলে অবিলম্বে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিন–চারটি ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তা দুর্বোধ্য ও অগ্রহণযোগ্য।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

    *মতামত লেখকের নিজস্ব