বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে কেমন নেতৃত্ব প্রয়োজন

ছাত্র আন্দোলন সব সময় বাংলাদেশে ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। ছাত্র সংসদে কোন ধরনের নেতৃত্ব প্রয়োজন, তা নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনফাইল ছবি

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের সময় অসাধারণ অনেক স্লোগান, দেয়াললিখন ও বক্তব্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল; কিন্তু ‘প্লিজ ভাই, কেউ কাউকে ছেড়ে যাইয়েন না’—এই বাক্য অনেকটা আড়ালেই থেকে গিয়েছিল। রক্তাক্ত রাজপথ থেকে উঠে আসা এই মিনতি নিছক কোনো বক্তব্য ছিল না; বরং এটি হয়ে উঠেছিল একটি প্রজন্মের মুক্তির আর্তনাদ।

ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা তাঁর অব গ্রামাটোলজি (১৯৬৭) বইয়ে যুক্তি দেন, ‘ভাষা কখনো নিরপেক্ষ নয়; প্রতিটি শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকে অজস্র গোপন শক্তি, যা সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন অর্থ ধারণ করে।’ সেই শক্তিই গণ–অভ্যুত্থানকালীন ওই আহ্বানকে সাধারণ একটি অনুরোধ থেকে ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতিতে রূপান্তর করেছিল।

একইভাবে মিশেল ফুকো তাঁর দ্য আর্কিওলজি অব নলেজ (১৯৭২) বইয়ে দেখিয়েছেন, ভাষা শুধু অর্থ বহন করে না; বরং ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবেও কাজ করে। রাষ্ট্র যখন ‘আইনশৃঙ্খলা’ শব্দ ব্যবহার করে, তখন তা দমননীতিকে বৈধতা দেয়; কিন্তু ছাত্রদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘কেউ কাউকে ছাইড়া যাইয়েন না’ কথাটি রাষ্ট্রীয় দমননীতিকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন বয়ান তৈরি করেছিল, যা ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে দৃশ্যমান করে তুলেছিল।

কিছু বৈশ্বিক উদাহরণ

পৃথিবীর নানা পটভূমিতে প্রতিরোধ আন্দোলনের স্লোগান জনগণের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে (বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন) কালো দক্ষিণ আফ্রিকানদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, ‘আমান্ডলা! আউয়েতু!’ (শক্তি জনগণের হাতে)। এ দুটি অসাধারণ শব্দ গোটা জাতিকে মুক্তির ডাক দিয়েছিল এবং সংগ্রামের শক্তি জুগিয়েছিল।

চিলির ১৯৭৩ সালের সামরিক স্বৈরশাসক পিনোশের শাসনবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ও শ্রমিকদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘এল পুয়েব্লো উনিদো হামাস সেরা ভেনসিদো’ (ঐক্যবদ্ধ জনগণ কখনো পরাজিত হবে না)। পূর্ব জার্মানিতে ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়াল ভাঙার আন্দোলনের সময় ছাত্ররা বলেছিল, ‘উইর সিন্ড আইন ভলক’ (আমরাই জনগণ)।

দক্ষিণ কোরিয়ার ১৯৮০-এর দশকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রবিদ্রোহেও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, ‘নো মোর সাইলেন্স!’ (আর নীরবতা নয়)। আবার যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে ছাত্র ও তরুণদের অংশগ্রহণ দেখিয়েছে, কীভাবে একটি বাক্য সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের প্রতীক হতে পারে।

এসব স্লোগান প্রমাণ করে, ছাত্রদের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি আহ্বান মানুষের হৃদয়ের অভিজ্ঞতা ও নৈতিক অবস্থানকে স্পর্শ করলে তা কেবল শব্দ থাকে না; বরং সমাজ বদলের শক্তিতে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান ও নেতৃত্ব সব সময় জাতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। এখানেও ছাত্রদের আহ্বান কখনো বিচ্ছিন্ন ছিল না; বরং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের উদ্যোগে পুরান ঢাকার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সংলাপের কথা উল্লেখ করেছেন ভাষাসৈনিক ও গবেষক আহমদ রফিক। আরেক ভাষাসৈনিক ও শিল্পী মুর্তজা বশীরও লিখেছেন, কাদের সরদারের নেতৃত্বে পুরান ঢাকার স্থানীয় নেতারা ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। এভাবেই ছাত্রদের আন্দোলন সামাজিক শক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল।

 ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রদের মুখে স্লোগান শোনা গিয়েছিল, ‘আপস নয়, সংগ্রাম সংগ্রাম...।’ এটি গোটা জাতির মুক্তির মন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।

আবার ১৯৯০ সালে ছাত্ররা এরশাদের স্বৈরশাসনের পতন ঘটাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আর সর্বশেষ চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি, ছাত্রদের আহ্বানে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিলেন।

এই অভিজ্ঞতা আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞানচর্চার জায়গা নয়; এখান থেকেই দেশের ইতিহাসের প্রতিটি বড় আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে।

ডাকসু নির্বাচন কি পরীক্ষার মঞ্চ

একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচন নিছক শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচনের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্ধারণের একটি মঞ্চ। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আমাদের সামনে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে, ছাত্রছাত্রীদের আসল নেতৃত্বে কারা?

আন্দোলনের দিনগুলোতে আমরা দেখেছি, অনেক সাহসী শিক্ষার্থী নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল না করে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। তাঁরা ছদ্মবেশের মতো কোনো কৌশলের আশ্রয় নেননি; বরং খোলাভাবে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আসছিলেন।

ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের কথা বলে এবং সৎ লোকের শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সময় কিংবা জাতীয় সংস্কৃতির প্রশ্নে এবং দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এসব ঐতিহাসিক ভুল এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা গুপ্ত রাজনীতির অভিযোগের কারণে তারা এবারও বিতর্কিত হয়েছে।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ আবারও একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। এ রকম অবস্থায় কোন ছাত্রদের ডাকে আমরা সাড়া দেব বা তাঁদের নেতৃত্ব হিসেবে দেখতে চাইব—সেটি একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এখন স্পষ্টভাবে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষ বিগত স্বৈরাচারের আমলেও নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় লুকায়নি এবং এখন তাঁদের আদর্শিক অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে। অপর পক্ষটি এত দিন ছদ্মবেশী বা গুপ্ত রাজনীতি করেছে এবং তাদের কথা ও কাজে এখনো অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে।

সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘যে জীবন নিজের বিচার পরীক্ষার মধ্যে যায়নি, তা বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।’ নেতৃত্বকে ঠিক একইভাবে পরীক্ষিত হতে হয়। যাঁরা নিজেদের অতীত ও বর্তমানের দায়বদ্ধতার মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস রাখেন, ডাকসু নির্বাচনে সেসব প্রার্থীই ছাত্রছাত্রীর যোগ্য নেতৃত্ব হতে পারেন।

আরও পড়ুন

ক্যাম্পাসভিত্তিক, উদ্ভাবনী ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব

এখনকার প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজকে নতুন করে ভাবতে হবে, কোন ধরনের নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে ক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ। কেবল রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে এখন আর ছাত্রদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়।

আমাদের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যাঁরা শুধু আন্দোলনেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদিনের বাস্তবতায় সক্রিয় থাকবেন; যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে জবাবদিহি আনতে সক্ষম হবেন, শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের আস্থা গড়ে তুলবেন এবং গবেষণায় আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন করে নতুন দিগন্ত খুলে দেবেন। তাঁরা হবেন সে রকম নেতৃত্ব, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন এবং বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখাতে পারবেন।

ক্যারিয়ার ভাবনা ও বিকল্প দৃষ্টি

ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বের ভাবনা কেবল গৎবাঁধা কথা ও কাজে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আজকের তরুণদের বড় অংশ নিজেদের কেবল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অথচ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গড়তে উদ্যোক্তা, গবেষক, উদ্ভাবক ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন আরও বেশি।

ছাত্র সংসদের নেতৃত্বকে এমন হতে হবে, যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের সামনে বিকল্প স্বপ্ন তুলে ধরবেন; তাঁরা বলবেন, শুধু সরকারি চাকরিই লক্ষ্য নয়; বরং জ্ঞান সৃষ্টি, কর্মসংস্থান, সামাজিক উদ্ভাবন ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পথ তৈরি করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রনেতাদের উচিত হবে তরুণদের শেখানো যে নেতৃত্ব মানে নিরাপদ ভবিষ্যতের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা নয়, নেতৃত্ব মানে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করা।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মুক্ত আলোচনার সংস্কৃতি

আমাদের চোখ রাখতে হবে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার দিকেও। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যে বিষয়গুলো আলোচনায় আসে, তা হলো শিক্ষা সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য দূরীকরণ, মানবাধিকার, প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। এ বিষয়গুলোই এখন তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় শিক্ষানীতি ও টিউশন ফি নিয়ে বিতর্ক হয়; যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি’ এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, আন্তর্জাতিক ছাত্রদের অধিকার ও পরিবেশনীতি নিয়ে মুক্ত বিতর্ক হয়েছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতৃত্বকেও একই রকম মানসিকতা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। তাঁদের বলতে হবে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কোথায় দাঁড়াবে এবং দেশের তরুণদের কীভাবে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আদর্শ ও উদাহরণ ছাড়া ছাত্ররা নেতৃত্বের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন না। তাই আমাদের এমন নেতৃত্ব দরকার, যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ হবেন এবং উদাহরণ সৃষ্টি করে অন্যদের পথ দেখাবেন।

বাস্তববাদী ছাত্ররাজনীতি

এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। নেতৃত্বকে হতে হবে বাস্তববাদী, যাঁরা জানেন রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র চলে না। আজ অনেক তরুণ রাজনীতিকে ঘৃণা করেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন রাজনৈতিক দল মানেই দুর্নীতি ও ক্ষমতার খেলা; কিন্তু বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক দল ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না।

ছাত্রনেতাদের কাজ হবে কোনো দল বা জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য না দেখানো, আবার একই সঙ্গে রাজনীতির প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন না করা। ছাত্রনেতাদের ভূমিকা হতে পারে ‘প্রেশার গ্রুপ’ বা চাপ প্রয়োগকারী শক্তির মতো। নেতৃত্বকে হতে হবে এমন, যাঁরা সরকারের কাছে গিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার বাজেট বাড়ানোর দাবি তুলবেন, সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলবেন, উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবনে প্রণোদনা আদায় করবেন এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবেন।

প্রান্তিক কণ্ঠ ও বাংলাদেশপন্থী নেতৃত্ব

প্রকৃত নেতৃত্ব কেবল ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক হবে না, তাঁদের ভাবনায় থাকতে হবে সমাজের প্রান্তিক মানুষের স্বপ্নও। আমরা শুনতে চাই সেসব নেতার কথা, যাঁরা প্রবাসী শ্রমিক, নারী শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক ও দিনমজুরের সংগ্রামের গল্প তুলে ধরবেন; যাঁরা পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, নারী ও সংখ্যালঘুদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অংশগ্রহণ এবং ভিন্নধর্মী গোষ্ঠীগুলোর সমান মর্যাদা নিয়ে কথা বলেন। নেতৃত্ব মানে কেবল অভিজাতদের রাজনীতি নয়, নেতৃত্ব মানে সমাজের সব প্রান্তের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করা।

ছাত্রনেতৃত্বকে হতে হবে বাংলাদেশপন্থী; এ ক্ষেত্রে কোনো বিভেদ–বিভাজন থাকা চলবে না। তাঁদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য হবে। হতে পারে আমাদের সামর্থ্য সীমিত; কিন্তু আমাদের স্বপ্ন সীমাহীন। আমরা দেখতে চাই কোন নেতৃত্ব এই বড় স্বপ্নগুলো দেখছেন, বাংলাদেশকে নিজেদের কণ্ঠে তুলে ধরছেন এবং কারা ছাত্রসমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন।

শেষ কথা

‘প্লিজ ভাই, কেউ কাউকে ছেড়ে যাইয়েন না’ কথাটি ছাত্রদের মুখে উচ্চারিত হলেও এটি ছিল জনগণের হৃদয়েরও আর্তনাদ। ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৫২ থেকে ২০২৪—প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্ররা জনগণকে ছেড়ে যাননি, জনগণও ছাত্রদের একা ফেলে দেননি। তাই আমরা যখন ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়েছি, তখন জনগণের পক্ষ থেকেও আহ্বান আসছে ‘তোমরা আমাদের ছেড়ে যেয়ো না।’

আমরা চাই, ছাত্রসমাজ সেই ত্যাগী নেতৃত্বকে বেছে নেবে, যারা শুধু নিজেদের জন্য নয়; বরং সব মানুষের কণ্ঠস্বর ধারণ করবে। আমরা চাই, ছাত্ররা তাঁদের আন্দোলন ও নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ধরে রাখুক, যাতে বাংলাদেশ আবারও ইতিহাসের সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে।

ইতিহাস দেখিয়েছে, ত্যাগ ও সততার ওপর দাঁড়ানো নেতৃত্বই দীর্ঘ পথ চলতে পারেন। ছদ্মবেশী বা গুপ্ত রাজনীতির অনুসারীরা হয়তো সাময়িক আলো কাড়েন; কিন্তু দ্রুত অন্ধকারে হারিয়ে যান। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল ছাত্রদের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্য একটি পরীক্ষা।

  • মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

    *মতামত লেখকের নিজস্ব