প্রথম আলোর সামনে নতুন সম্ভাবনা, নতুন চ্যালেঞ্জ

আগামী বছরগুলোয় প্রথম আলোর সামনে নতুন সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।

লন্ডনে আমাদের পাড়াতে বিভিন্ন বয়সের লোক থাকে। তবে বয়স্কদের সংখ্যা একটু বেশি। সকালে জানালার পাশে দাঁড়ালে এখনো দেখা যায়, হাতে গোনা কিছু লোক পাড়ার দোকান থেকে পত্রিকা নিয়ে ঘরে ফিরছেন। তবে তিন দশক ধরে, বিশেষ করে মহামারির পর থেকে এই সংখ্যা চোখের সামনে পাতলা হতে শুরু করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রমরমা এই যুগে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ সংবাদ পড়লেও তা বিশ্বাস করে না। এখনো ৫১ শতাংশ ব্রিটিশ ভোক্তা সংবাদের জন্য অনলাইন বা ছাপা পত্রিকার ওপর নির্ভর করে। গত ২৫ বছরে বদলে গেছে ভোক্তার অভ্যাস, চাহিদা, মনন আর মনঃসংযোগ।

গবেষণামতে, আমরা প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা কম্পিউটার বা মুঠোফোনের স্ক্রিনের সামনে থাকি। একজন মানুষ ২০০০ সালে একটানা ১২ সেকেন্ড যেকোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারতেন। এখন ৮ সেকেন্ড। তৈরি হয়েছে অ্যাটেনশন ইকোনমি বা মনোযোগ অর্থনীতির এক বিশাল বাজার।

ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এই পরিস্থিতিতে নিজেদেরও বদলে ফেলেছে বনেদি সংবাদপত্রগুলো। ২১৯ বছরের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে ২০০৪ সালে পত্রিকার সাইজ ছোট করে দ্য টাইমস। বিনিয়োগ করে অনলাইন সংস্করণে।একই পথে পা বাড়ায় নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান আর ইন্ডিপেনডেন্ট-এর মতো পত্রিকা।

নিউইয়র্ক টাইমস পরিবর্তনের এই সুযোগ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য, সুখপাঠ্য এবং বিষয় বৈচিত্র্যে ভরা লেখার সম্ভার নিয়ে সাজিয়ে তুলেছে তাদের ডিজিটাল সংস্করণ। তবে সবাই বদলাতে পেরেছে, তা নয়।

যারা পারেনি, তারা বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা টিকে আছে না থাকার মতো। গত ২৫ বছরে প্রথম আলো ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেদের বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরেছে। সংবাদের জন্য বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী পাঠকের অন্যতম প্রধান গন্তব্য প্রথম আলো। পরিবেশন থেকে শুরু করে বিপণন বা নতুন ব্যবসায়ী উদ্যোগ—সব জায়গাতেই প্রথম আলোর নতুন উদ্যোগ চোখে পড়ে।

যে দেশে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা, সেই দেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে একটি সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। একটি সফল প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে দক্ষ জনবল আর নেতৃত্ব। তৈরি হয় আরও প্রতিষ্ঠান।

এগিয়ে আসতে হবে প্রথম আলোর মতো পত্রিকাকে। পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের একটি ভূমিকা থাকে। ২৫ বছর ধরে কাজটি প্রথম আলো বেশ ভালোভাবেই করে এসেছে। পাঠকের রুচি তৈরির এসব কাজ অনেক সময় পাঠকপ্রিয় না-ও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। পাঠককে নতুনভাবে ভেবে দেখার সুযোগ করে দিতে হবে।

বিভিন্ন সামাজিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক উদ্যোগেও প্রথম আলো স্বকীয়তা দেখিয়েছে, বিশেষ করে বিজ্ঞান আর গণিতকে জনপ্রিয় করার জন্য।

বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের জনপ্রিয় করার এই রীতি চালু করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। ১৯১৯ সালে। শুরুটা হয়েছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে। কঠিন কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ তত্ত্ব সাধারণকে বোঝানোর জন্য দিনের পর দিন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এমনকি একদিন দুই পাতাও বরাদ্দ ছিল আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে।

বিজ্ঞান আর গণিত ছাড়া আগামীর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে জায়গা করে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত গণিত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছেন। বলে রাখা ভালো, বিলেতে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ অঙ্কে কাঁচা।

২৫ বছর ধরে প্রথম আলো বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশে গণিতকে ভালোবাসে—এমন কিছু মানুষ তৈরি করতে পেরেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, গণিতভিত্তিক এ রকম প্রতিযোগিতা থাকলে গণিতে উৎসাহীর সংখ্যা আরও বেশি হতো। প্রথম আলোর আরেকটি বড় প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো, পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে অদম্য মেধাবীদের অর্জন সবার সামনে তুলে আনা আর তাদের এগিয়ে যেতে প্রণোদনা দেওয়া।

আগামী বছরগুলোয় প্রথম আলোর সামনে নতুন সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।

তথ্যপ্রযুক্তি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভূতপূর্ব অগ্রগতি প্রতিনিয়ত নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। ইউরোপ আর আমেরিকার বড় সংবাদপত্রগুলো ইতিমধ্যে গবেষণা, তথ্য যাচাই, পাঠকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করছে।

সংবাদ তৈরিতে পুরোমাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের অনেক ঝুঁকি রয়েছে। যেকোনো সংবাদের সঙ্গে পাঠকের সম্পৃক্ততা তৈরি করতে সংবেদনশীলতার দরকার হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সেটি সম্ভব নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অপব্যবহার করে অসত্য, অর্ধসত্য, অপতথ্য আর গুজব তৈরি একদম হাতের মুঠোয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি মুঠোফোনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাণিতিক হারে একাধিক মাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো সম্ভব। আগামী বছরগুলোয় মূলধারার সংবাদপত্রগুলোকে‌ মিথ্যার মহামারিকে মোকাবিলা করতে হবে। মিথ্যার এ মহামারি রুখতে পাঠককেও প্রস্তুত করতে হবে।

এগিয়ে আসতে হবে প্রথম আলোর মতো পত্রিকাকে। পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের একটি ভূমিকা থাকে। ২৫ বছর ধরে কাজটি প্রথম আলো বেশ ভালোভাবেই করে এসেছে। পাঠকের রুচি তৈরির এসব কাজ অনেক সময় পাঠকপ্রিয় না-ও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। পাঠককে নতুনভাবে ভেবে দেখার সুযোগ করে দিতে হবে।

দুর্ভাগ্যক্রমে অপতথ্যের মহামারি সঠিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের থেকে বেশি সংক্রামক। তবে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। সুপাঠ্য, বস্তুনিষ্ঠ ও প্রগতিশীল সংবাদপত্রের চাহিদা এখনো কমেনি। প্রথম আলো শতবর্ষী হোক, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আলো ছড়াতে থাকুক।

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    [email protected]