আমাদের শৈশবে দিনটি ছিল অসীম আনন্দের। আজ বই–খাতা থেকে ছুটি। আজ বসন্ত পঞ্চমী তিথি। আজ হলুদ আর শর্ষেতে মন রাঙাব। পদ্মশিমুল আর বেলপাতায় মাকে অঞ্জলি নিবেদন করব। আজ বাড়িতে বড়দের চোখরাঙানি নেই। আজ শুধু মায়ের পড়ার দিন। আমার বইগুলোও মায়ের চরণে নিবেদন করেছি। বাল্যশিক্ষা আর চক–পেনসিলে মায়ের চরণে হাতেখড়ি নিয়েছি। মায়ের কাছে দিব্যি নিয়েছি, মন দিয়ে পড়ব। সব পরীক্ষায় আর কেউ না হোক মাকে অন্তরে স্মরণ যেন করি শতবার। মিনতি করি বহুবার। ভুল যেন না করি। উতরে যাই তোমারই ভরসায় বারবার।
আমাদের কৈশোরে স্কুলে দল বেঁধে আয়োজন চলত সরস্বতীপূজার। পূজা এলে আমি বা যারা সনাতন, শুধু তারাই নয়, ক্লাসের অন্যরাও থাকত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার নানা আয়োজনে। বন্ধু রাশেদ, সালমি বা অসীম গোমেজরা ছড়া পাঠ করত সন্ধ্যার বিচিত্রা অনুষ্ঠানে। মজাদার লুচি আর সবজিতে থাকত সন্ধ্যার আপ্যায়ন পর্ব।
শ্বেতশুভ্র বসনে মা যেন সব অপবিত্রতা আর মলিনতা দূর করে দিত। আঁধারে আলো নিয়ে দাঁড়াত পাশে। কানে বাজে মায়ের প্রণাম মন্ত্র, ‘ওঁম জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে, বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী দেবী নমোস্তুতে; ওঁম সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।’
জ্ঞান সাধনায়, পবিত্রতায় বিদ্যার দেবীকে খোঁজে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। কিন্তু আজ আর তাতে থেমে নেই। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে মাকে পূজি, তখন দেখেছি মায়ের আরেক বিশ্বরূপ। মা বিরাজ করেন সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে পূজার আয়োজনে মাকে পাওয়া যায় বহুরূপে। সেখানে রসায়নে মা যেমন গবেষকের ভূমিকায়, তেমনি গণিতে সিদ্ধহস্ত। অন্যদিকে বাংলায় তিনি যেন সাহিত্যের চিরায়ত মূর্তি, চারুকলা আর সংগীতে বীণারঞ্জিত হস্তে মা আছেন অপার সাধনায়। দুশ্চিন্তা আর পাঠের অমনোযেগিতায় যাকে খুঁজি, তিনি আর কেউ নন, মা সরস্বতী।
‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’ শিক্ষাই জীবনের পাথেয়। শিক্ষা সবাইকে বিনয়ী করে তোলে। আসুন আজকের এই দিনে আমরাও জ্ঞানের আলোয় কুসংস্কারমুক্ত হয়ে আলোর পথে জীবনকে পরিচালিত করার শপথ নিই।
সরস্বতীপূজার ইতিহাস খুঁজে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনি জানা যায়। একাধিক পুরাণে সরস্বতী দেবীর বর্ণনা এসেছে। পুরাণ বলছে, সরস্বতী দেবী ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর সংগীত, বিদ্যা ও কলাশিল্পের প্রতি গভীর প্রতিভা ছিল। ব্রহ্মা তাঁকে বুদ্ধি, জ্ঞান ও শিক্ষা দিতে পারেননি। দেবী সরস্বতী নিজেই সাধনাবলে এগুলোর প্রতিভা অর্জন করেন। তাই সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবে পূজিত হন।
এই বঙ্গে সরস্বতীপূজার বিশেষ স্থান রয়েছে। বিশেষত শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা দিনটি তাঁদের বই, খাতা ও লেখার সরঞ্জাম দেবীর পায়ে অর্পণ করেন। দিনটি জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষায় উন্নতি লাভের একটি শুভ দিন হিসেবে পরিগণিত হয় সর্বত্র।
ইতিহাস বলে, বাংলায় সরস্বতীপূজা শুরু ১৮০০ সালের দিকে।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৮০০-১৮৪৫) এই সময়কালে সরস্বতীপূজা শুরু করেছিলেন। রাজার বাড়িতে এই আয়োজনে সব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। আর সরস্বতী দেবীর পূজা অর্চনাকে রাজা নিয়েছিলেন একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে। যেখানে শিক্ষার্থীরা বইপত্র দেবীর সামনে রেখে প্রার্থনা করতেন, পূজা করতেন এবং তাঁদের বিদ্যা ও জ্ঞানের উন্নতির জন্য দেবীর আশীর্বাদ চাইতেন।
সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। তিনি পদ্মাসনে অধিষ্ঠিতা। দেবী সরস্বতীর এক হাতে বীণা, অন্য হাতে পুস্তক। আর দেবীর বাহন রাজহংস। বসন্ত পঞ্চমীতে সরস্বতীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে শিক্ষার্থীদের জন্য। সবাই মায়ের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে জ্ঞান লাভের জন্য।
‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’ শিক্ষাই জীবনের পাথেয়। শিক্ষা সবাইকে বিনয়ী করে তোলে। আসুন আজকের এই দিনে আমরাও জ্ঞানের আলোয় কুসংস্কারমুক্ত হয়ে আলোর পথে জীবনকে পরিচালিত করার শপথ নিই।
কাজল ঘোষ, সাংবাদিক