খাদ্য আর জ্বালানি কিনতে না পারার চেয়ে বড় সংকট আর কী

কেবল পরিসংখ্যান বা সূচক দিয়ে দুনিয়া চলে না। আবার সেই সূচক যদি হয় গোঁজামিলে ভরা, তাহলে তো কথাই নেই। সূচকের ভিত্তিতে সব চললে যোগ-বিয়োগ করে হিসাব মিলিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু বাস্তব জীবনের সঙ্গে হিসাবের অনেক ফারাক থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই ফারাক শাসকেরা পরিকল্পিতভাবেই করে থাকেন। তাই আমাদের চারপাশে এ সংকট, ঝামেলা। এসব ঝামেলা বাস্তব জীবনের ভিত্তিতেই সমাধান করতে হয়। কেবল সূচকের দিকে তাকিয়ে থাকলে জীবনের হিসাব, রাষ্ট্রের হিসাব মিলে না।

দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। সাধারণ মানুষ খুব বেশি স্বস্তিতে নেই। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যয়ের হিসাব কাটছাঁট করেও জনসাধারণের হাতে খাবার কেনার পর্যাপ্ত অর্থ থাকছে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাবে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ যথাযথ পরিমাণ খাদ্য নিতে পারছে না। খাবার কিনতে অনেকে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে না পেরে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ওই জরিপে ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, গত ছয় মাসে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বড় আঘাত হেনেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।

বর্তমানে বাজারে পণ্য নেই এমন কথা বলা যাবে না। মানুষের হাতে টাকা নেই এ কথাও পুরোপুরি বলা যাবে না। কিন্তু যে টাকা আছে ওই টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সবকিছু জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। ঘরের জিনিস বিক্রি করে অনেকে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েছে খাবার কিনছে। ওদিকে বেকারত্বও বাড়ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতির কারণে কলকারখানার উৎপাদন কমে আসছে। ফলে বেকারত্ব আরও বাড়তে পারে।

উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক অনুসারে এমন পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়। আমাদের গত এক দশকের উন্নয়নের সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সম্প্রতি আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-এর হিসাবে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। চরম দরিদ্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি মূল্যে জিডিপির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। উন্নয়নের হুলুস্থুল কাণ্ড এই সূচকগুলোকেই সমর্থন করে। বড় বড় ব্রিজ, টানেল, রোড, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, দুস্থ ব্যক্তিদের বাড়ি করে দেওয়া—কী নেই এ উন্নয়নের তালিকায়।

তাহলে জনজীবনে এ দুর্বিষহ অবস্থা কেন? এসব সূচকের সঙ্গে বাস্তবের জীবন মিলছে না। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ব্যবসায়ীদের সরাসরি বলে দিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি আমদানির ডলার সরকারের হাতে নেই। তিনি বলেছেন, ‘সামনে কী হবে, আমরা জানি না।’ সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।

এর কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সতর্ক করে বলেন, সামনে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে। তিনি জ্বালানি তেলের বিকল্প হিসেবে ভেন্নার তেল প্রয়োজনে ব্যবহারের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। তবে দুর্ভিক্ষ হবে কি না, আমরা সেটা নিশ্চিত নই। এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলাও যায় না। আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলে মানব সৃষ্ট দুর্ভোগ এড়ানো সম্ভব। কেবল উপসর্গ বিবেচনা করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা যায়।  

বর্তমানে বাজারে পণ্য নেই এমন কথা বলা যাবে না। মানুষের হাতে টাকা নেই এ কথাও পুরোপুরি বলা যাবে না। কিন্তু যে টাকা আছে ওই টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সবকিছু জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। ঘরের জিনিস বিক্রি করে অনেকে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েছে খাবার কিনছে। ওদিকে বেকারত্বও বাড়ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতির কারণে কলকারখানার উৎপাদন কমে আসছে। ফলে বেকারত্ব আরও বাড়তে পারে।

তাহলে ওপরে যেসব সূচকের কথা উল্লেখ করলাম জনজীবনে তার প্রতিফলন কোথায়? এই সূচকগুলোকে বিশ্বাস করলে হুট করে অর্থনীতির দুরবস্থা হওয়ার কথা নয়। অভিযোগ রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে সূচক তৈরিতে অনেক সময় প্রকৃত তথ্য গোপন করে ইচ্ছামতো সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। মূলত অগণতান্ত্রিক দেশগুলোয় এ ধরনের ভুয়া পরিসংখ্যান তৈরি করে জনসাধারণকে একধরনের বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে শাসকগোষ্ঠী। পরিসংখ্যানগত মিথ্যাচারিতার পাশাপাশি বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করে উন্নয়নের পর্দা ঝোলানো হয়। এতে দুই ধরনের সুবিধা হয় শাসকগোষ্ঠীর। প্রথমত, বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করে জমকালো উদ্বোধনের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে উন্নয়নের নমুনা তুলে ধরা হয়। কেবল উন্নয়ন আর উন্নয়ন দেখা যায়। কিন্তু এই পর্দার আড়ালে থাকে বিশাল বিশাল দুর্নীতি, অর্থ পাচারের গল্প।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ খাতের উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। বর্তমানে আমাদের বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকট ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ খাতকে একই সঙ্গে ‘উন্নয়ন’ ও দুর্নীতির সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঢালাও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে বিদ্যুতের সংকট মিটে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা ঘটা করে প্রচার করা হয়।
কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের এই উন্নয়ন টেকসই ছিল না। আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর সরকার ঘনিষ্ঠদের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার দুয়ার খোলে দেওয়া হয় ক্যাপাসিটি চার্জের নামে। এই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারে। আমদানির নামেও হতে পারে। কারণ, আমাদের রপ্তানি আয়ের থেকে আমদানি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১-২২-এর হিসাব অনুসারে, গত বছরের জুলাই থেকে মার্চ ৪৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় ছিল ৭১ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। শেষ পর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ৮৯ বিলিয়ন ডলারে। স্বভাবতই অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়, অর্থ পাচার, ব্যয়বহুল উন্নয়নের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে টান পড়েছে।

তহবিল সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ বা করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করা হলেও বিদ্যুৎ খাতের বা সার্বিকভাবে অর্থনীতির এই পরিণতি অনিবার্য ছিল। এর কারণ রাজনৈতিক এবং গণতন্ত্রের সংকট। এটা এড়ানোর কোনো পথ সরকারের হাতে ছিল না। লাগামহীন দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন ব্যয় আশপাশের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। কর্তৃত্ববাদী শাসনে অতিরিক্ত ব্যয়ে উন্নয়নের নামে নানাভাবে অর্থ ছড়িয়ে সুবিধাবাদী শ্রেণি তৈরি করা হয় শাসনক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আর ঝাঁ-তকতকে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। দেশজুড়ে বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ভিড় বাড়তে থাকে। সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী থাকে সরকারের দেওয়া হিসাব অনুসারে। সবকিছুই মনে হবে ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু হুট করেই এই উন্নয়ন ঠুস করে ধসে পড়ে একসময়। কারণ, এই উন্নয়ন সমভাবে বণ্টিত হয়নি। এই উন্নয়ন গুটিকতক মানুষের অর্থ তৈরির প্রক্রিয়া, প্রবঞ্চনার গল্প।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ইতিমধ্যেই সংকটের মধ্যে আছি? রাজনৈতিক অর্থনীতি বলে একটা জিনিস আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ সূচক নির্ভর কথা বলেন। রাজনীতি ও অর্থনীতিকে তাঁরা একসঙ্গে দেখতে চান না। সুশাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ককে এড়িয়ে তাঁরা কেবলই সূচকের কথা বলতে চান। সূচক দিয়ে তাঁরা জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেবল সূচক দিয়ে দেশ চলে না, এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ থাকাটাও জরুরি। এই ধারার অর্থনীতিবিদেরা কার্যত শাসকবর্গেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। সংকট নিয়ে তারা পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না বটে কিন্তু তৌফিক–ই-ইলাহীর মতো ক্ষমতার অংশীদাররাই জানিয়ে দিচ্ছেন সংকট শুরু হয়ে গেছে। মানুষ কিনতে পারছে না খাবার। সরকার পারছে না জ্বালানি কিনতে। খাদ্য আর জ্বালানি কিনতে না পারার থেকে বড় সংকট আর কি হতে পারে একটি দেশের জন্য।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন