প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে। এদিন মানুষকে হৃদ্রোগ সম্পর্কে সচেতন করা এবং হৃদয়ের যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। হৃদ্রোগ আজ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ, অথচ এর অধিকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য। তাই এদিন শুধু একটি প্রতীকী উদ্যাপন নয়, বরং একটি বৈশ্বিক আন্দোলন, যার লক্ষ্য হলো হৃদ্রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ হৃদয় গড়ে তোলা।
বিশ্ব হার্ট দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য
বিশ্ব হার্ট ফেডারেশনের উদ্যোগে ২৫ বছর ধরে ২৯ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এই সময়ের মধ্যে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে হৃদ্রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা যায়, তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর কাছে হৃদ্রোগকে স্বাস্থ্যনীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিলিয়ন মানুষের অংশগ্রহণে ইতিহাসের প্রথম গ্লোবাল পিটিশন চালু করা হয়েছে।
এ বছর দিবসটির ২৫তম বার্ষিকী। তাই এর গুরুত্ব অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী হৃদ্রোগের বোঝা কমাতে এখনই আমাদের দৃঢ় ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
হৃদ্রোগের ভয়াবহ বাস্তবতা
প্রতি ৫ জনে ১ জন মানুষ অকালে হৃদ্রোগে মারা যায়। ক্যানসার বা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের রোগের তুলনায় হৃদ্রোগ বেশি প্রাণ নিচ্ছে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ৮০ শতাংশ হৃদ্রোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য।
প্রতিবছর প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ মানুষ হৃদ্রোগে মারা যাচ্ছে। শুধু স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সচেতনতা ও সহজলভ্য চিকিৎসার মাধ্যমে এর বড় একটি অংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব হার্ট দিবসের সাফল্য
বিশ্ব হার্ট দিবস ইতিমধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
বার্তা পৌঁছানো: গত দুই বছরে প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষের কাছে হৃদ্রোগ প্রতিরোধের বার্তা পৌঁছেছে।
একত্রকরণ: বিশ্ব হার্ট ফেডারেশনের ১২০টিরও বেশি সদস্য সংগঠন, জনপ্রিয় ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ও বিনোদন তারকাদের সঙ্গে যুক্ত করা গেছে।
বিশ্বকে উজ্জ্বল করা: বিশ্বের ১০০টিরও বেশি আইকনিক স্থাপনা লাল আলোয় রাঙানো হয়েছে, যেমন সুইজারল্যান্ডের Jet d'Eau, কানাডার Niagara Falls, নিউজিল্যান্ডের Sky Tower, এমনকি মিসরের ঐতিহাসিক পিরামিডও।
এসব পদক্ষেপ হৃদ্রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক ঐক্যকে প্রতিফলিত করে।
কেন এখনই পদক্ষেপ জরুরি
কোভিড-১৯ মহামারি, বৈশ্বিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে মানুষ শুধু প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না, বরং নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়েও যথাযথ যত্ন নিতে পারছে না। এর ফলে হৃদ্রোগের ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
প্রতিবছর ৬৫ লাখ মানুষ অকালে মারা যায় হৃদ্রোগে।
দৈনিক মাত্র ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে পারে, কিন্তু প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন এবং ১০ জন তরুণের মধ্যে ৮ জন যথেষ্ট হাঁটে না।
উচ্চ রক্তচাপের প্রতি ৫ জন রোগীর মধ্যে মাত্র ১ জন সঠিক চিকিৎসা পান। অথচ যদি ২ জনে ১ জন চিকিৎসা পেতেন, তবে প্রায় ১৩ কোটি জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো।
আমাদের অঙ্গীকার ও আহ্বান
এই বছর বিশ্ব হার্ট দিবসের মূল বার্তা হলো: হৃৎস্পন্দন থামলে থেমে যাবে জীবন—‘হারাতে দেবেন না একটিও স্পন্দন।’
আমাদের করণীয়
স্পন্দন সচল রাখুন: হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিন অন্তত ২৫ মিনিট শরীরচর্চা করুন। ২৫তম বার্ষিকীর সম্মানে অন্তত ২৫ দিন নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করুন।
প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করুন: সরকার ও স্বাস্থ্য খাতকে হৃদ্রোগ স্ক্রিনিং ও চিকিৎসার প্রবেশাধিকার দ্বিগুণ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
পিটিশনে অংশ নিন: বৈশ্বিক পিটিশনে স্বাক্ষর করে চিকিৎসাসেবার সহজলভ্যতা বাড়াতে সবাই ভূমিকা রাখুন।
উপসংহার
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও হৃদ্রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার অনেক বেশি। তবে আশার কথা হলো হৃদ্রোগ প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রতিশ্রুতি এবং সম্মিলিত উদ্যোগ। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। সুস্থ হৃদয় মানেই সুস্থ জীবন।
আসুন, আমরা সবাই মিলে বিশ্ব হার্ট দিবসের ২৫তম বর্ষপূর্তিতে প্রতিজ্ঞা করি:
প্রতিটি হৃৎস্পন্দনকে মূল্যবান করে তুলব।
হৃদ্রোগ প্রতিরোধে নিজে সচেতন হব এবং অন্যকে সচেতন করব।
সবার জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অবদান রাখব।
সুস্থ হৃদয়, সুস্থ জীবন—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আর এই সুস্থ হৃদয়ের জন্য প্রতিটি হৃৎস্পন্দন অপরিহার্য। তাই প্রতিটি হৃৎস্পন্দন সচল এবং ছন্দময় রাখতে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা, বাংলাদেশ