গৃহকর্মী নির্যাতন: বিজয়ের মাসে পরাজিত তানিয়ারা

৯৯৯-এ ফোন পেয়ে পুলিশ যখন বনানীর বাসায় গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে, তখনো তাঁর মুখে স্কচটেপ ও হাতে সুপার গ্লু লাগানো ছিল
ছবি: সংগৃহীত

গৃহকর্মী তানিয়ার অপরাধ ছিল তাঁর শিশুটি কান্না করত। আর শিশুটি কান্না শুরু করলেই শুরু হতো তানিয়ার ওপর নির্যাতন। ঠোঁটে স্কচটেপ আর হাতে গ্লু লাগিয়ে বিভিন্ন কায়দায় করা হতো নির্মম নির্যাতন। ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে ২০ ডিসেম্বর রাজধানী বনানীর একটি ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ মেয়েটিকে ওই অবস্থায়ই উদ্ধার করে, গ্রেপ্তার করে গৃহকর্ত্রী সামিনা আলমকে। এ পর্যন্ত পুলিশ দ্রুতই ব্যবস্থা নিয়েছিল, কিন্তু গোল বাধল পরে। পুলিশকে ছেড়ে দিতে হয় প্রভাবশালী সামিনা আলমকে। কোনো মামলাই দায়ের করা যায়নি। বোঝা যাচ্ছে পুলিশের অসহায়ত্ব। পুলিশ বলেছে, ‘ভুক্তভোগী প্রাপ্তবয়স্ক, তিনি মামলা করতে চান না। আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে তাঁদের সাপোর্ট লাগবে।’ মেয়েটির ভাই বলেছেন, ‘যাঁরা তাঁর বোনকে নির্যাতন করেছেন, তাঁরা প্রভাবশালী। মামলা করে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। তা ছাড়া মামলার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই’ (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২)। এক ভয়ংকর সত্য উচ্চারণ। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন এবং মামলার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই।

তানিয়ার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমাগতভাবে গৃহকর্মীদের ওপর এ ধরনের নির্মম নির্যাতনের কারণে গৃহশ্রমিকদের মৃত্যুর খবর ও বীভৎস ক্ষতচিহ্নের ছবি প্রায়ই পত্রিকার খবর হচ্ছে। আবার সব কটি ঘটনাই প্রায় একই কায়দায় ফয়সালা হয়ে যায়। প্রথমে পুলিশের তৎপরতা, সমাজের সহানুভূতি, তারপর মামলা হারিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ১০ বছর আগে এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, গৃহশ্রমিক হত্যা ও নির্যাতনের ১০টি মামলার মধ্যে মাত্র একটির বিচার হয়ে নির্যাতনকারীর শাস্তি হয়েছিল। ওই শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিও কিছুদিনের মধ্যে মানসিক রোগীর সনদ দেখিয়ে সাজা মওকুফ পেয়ে যান। সন্দেহ নেই, এসব নির্যাতনের ধরন দেখে এঁদের সহজেই মানসিক রোগী সাব্যস্ত করা যায়। কিন্তু এঁদের কাউকেই মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়নি।

মামলা হারিয়ে যাওয়ার অথবা মামলা না হওয়ার (যেটি হয়েছে প্রভাবশালী সামিনার ক্ষেত্রে) নেপথ্যে কৌশল আজ ওপেন সিক্রেট। নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর পরিবারকে প্রথমত কিছু অর্থ প্রদান, দ্বিতীয়ত গ্রামের প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি দেখানো, তৃতীয়ত মামলা করলে যে কিছু হবে না, সেটি বিভিন্নভাবে তুলে ধরা। অসহায় পরিবার তার অন্যান্য সন্তানের কথা চিন্তা করে লোভ ও ভয়—এ দুইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

এ ধরনের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে, চাঁদপুরের শিশু গৃহশ্রমিক জান্নাত নির্যাতনের ঘটনা। ওই শিশুর নির্যাতনের বীভৎসতা এত ভয়ংকর ছিল যে পুরো দেশ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। চাঁদপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক সক্রিয়ভাবে উভয়েই এ মেয়েটির সুরক্ষা ও মামলার বিচার সম্পন্ন করার উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী, শ্রমসচিব, প্রথম আলো ট্রাস্ট, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বিলস সবাই এগিয়ে এসেছিল মেয়েটিকে সহায়তায়। মামলা হয়েছিল, গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন কয়েকজন। কিন্তু সে মামলাটিও হারিয়ে গেছে এক বছরের মাথায়।

আমরা যে সংবাদগুলো দেখতে পাই তা প্রকৃত ঘটনার কিয়দংশমাত্র, নির্যাতিতের যে চিৎকারগুলো স্কচটেপের ফাঁক দিয়ে দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসে, তা–ও হারিয়ে যায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিষ্ক্রিয়তায় এবং অর্থের দাপটে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য আইনের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন একটি সুরক্ষাকবচ হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মানবাধিকারকর্মীদের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওই আইনে গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।

আইনজীবীদের মতে, দেশে ফৌজদারি আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করাই সংগত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বোধগম্য কারণেই পুলিশ তা করেনি বা করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলাগুলো হারিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ তদন্ত শেষ না করে আদালতে প্রতিবেদন জমা না দেওয়া। বিভিন্ন সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে একই উত্তর পাওয়া গেছে। যেহেতু অভিযোগকারীই মামলা পরিচালনা করতে আগ্রহী হন না, তাই অন্যান্য মামলার চাপে পুলিশ আর এগুলো নিয়ে এগোয় না।

মামলা না করা ও তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়া এবং সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য আইনি জটিলতা এবং পুলিশের অসহায়ত্বের পাশাপাশি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার প্রধান কারণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সব নির্যাতনের ঘটনাই ঘটে ঘরের ভেতরে। আমরা যে সংবাদগুলো দেখতে পাই তা প্রকৃত ঘটনার কিয়দংশমাত্র, নির্যাতিতের যে চিৎকারগুলো স্কচটেপের ফাঁক দিয়ে দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসে, তা–ও হারিয়ে যায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিষ্ক্রিয়তায় এবং অর্থের দাপটে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য আইনের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন একটি সুরক্ষাকবচ হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মানবাধিকারকর্মীদের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওই আইনে গৃহশ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।

তানিয়ার ভাইয়ের সরল স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে সমাজের এক গভীর ক্ষত আমাদের সামনে ভেসে উঠছে। এক প্রবল প্রতাপশালী গোষ্ঠী আজ সমাজের প্রভু হয়ে উঠেছে এবং অর্থ ও প্রভাব দিয়ে সবকিছুকে বৈধ করছে। সবকিছুই যেন আদিযুগের রক্তঋণ শোধ করে অব্যাহতি পাওয়ার বিধান।

তানিয়ার ভাই শফিকুর রহমান যখন সাংবাদিকদের কাছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তাঁদের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন, তখনো ৫১তম বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের রেশ কাটেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের অর্জন অনেক। তবে স্বাধীনতার সঙ্গে কোনো কিছুকেই তুলনা করা যায় না। কিন্তু ৫০ বছরের সালতামামিতে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনাবিধ্বংসী প্রভাবশালীদের উত্থান এবং তার বিপরীতে নির্যাতিতদের অসহায়ত্ব এমনকি মামলা করতেও ভয় পাওয়া নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন করে এবং এসব নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নেওয়ার তাগিদ দেয়। স্বাধীনতার ৫১তম বর্ষে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হোক, এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে তানিয়ারা ভয়লেশহীনভাবে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন, যেটিই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।

  • সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)
    ইমেইল: [email protected]