বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রতিযোগিতা আইনে যে সমস্যা

নতুন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, তার মধ্যে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ অন্যতম।ছবি : প্রথম আলো

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ পায় প্রতিযোগিতা আইন। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল বাজার থেকে বিভিন্ন রকমের সিন্ডিকেট, মনোপলি, অলিগোপলি নির্মূল করা। ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হয়। এই আইন অনুযায়ীই ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।

বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইনের সমস্যা অনেক। দর্শনগত ভিত্তি থেকে শুরু করে, আইনের কার্যকরণ এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজি অনুবাদ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যথাযথ গবেষণা আর জুডিশিয়াল মাইন্ড (বিচারিক মন) অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে এই প্রবন্ধে আমি তিনটি প্রধান সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করব।

প্রথমত, প্রতিযোগিতা আইনে প্রতিযোগিতা–সংক্রান্ত মামলাপ্রক্রিয়া যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, তা আইনবিজ্ঞান অনুযায়ী বেশ সমস্যার উদ্রেক করে। প্রতিযোগিতা কমিশন একই সঙ্গে বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বিচারক। প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা কমিশন ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি মামলা রুজু করতে পারে না; কেবল অভিযোগ দায়ের করতে পারে।

সত্যি বলতে এই সমস্যা কোনো নতুন সমস্যা নয়। সব সময়ই দেখা গেছে, এই সমস্যার ক্ষণস্থায়ী সমাধান করা হয়েছে। তবে এর স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিযোগিতা কমিশন

অভিযোগ কমিশনের মনঃপূত হলে প্রতিযোগিতা কমিশন নিজে সেই বিষয়ে বাদী হয়ে মামলা রুজু করে পরিচালনা করে। আবার সেই মামলার তদন্ত করার দায়িত্বও কমিশনের। আবার তদন্তের ফলাফল গ্রহণ করে বিচার করার ক্ষমতাও তাদেরই। একই ব্যক্তি বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা আবার বিচারক হলে তা অংশীজনের ততটা আস্থা অর্জন করতে না পারলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কোনো ব্যবস্থা যদি নকশাতেই সব অংশীজনের ভরসার জায়গা হতে না পারে, তা কার্যকর হয় না। ভারতীয় প্রতিযোগিতা আইন অনুসারে প্রতিযোগিতা কমিশনের তদন্তের কাজ আর বিচারের কাজের দায়িত্ব দুটি পৃথক সত্তার ওপর ন্যস্ত। আমাদের আইনের ক্ষেত্রেও সেটা করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতা আইন একটি বিশেষায়িত আইনের শাখা। এর নিজস্ব স্বতন্ত্র আইনবিজ্ঞান আছে। এর ভাষা ও কার্যকারণ আলাদা। সারা বিশ্বেই এই আইনের প্রয়োগে এই আইনের বিশেষজ্ঞরাই নিয়োগ পেয়ে সম্পাদন করে থাকেন। কারণ, অতিরিক্ত প্রয়োগ বাজারকে নষ্ট করতে পারে, আবার মশা মারতে কামান দাগলে অংশীজনদের ব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট হয়।

প্রতিযোগিতা কমিশনে এখন পর্যন্ত যাদের চেয়ারম্যান বা সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রায় সবার মাঝেই একটা সাধারণ বিষয় ছিল—কারোরই প্রতিযোগিতা আইন নিয়ে বা প্রতিযোগিতা অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া বা কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। আবার কমিশনে নিয়োগের মেয়াদ তিন বছর হওয়ায় কমিশনের কাজের সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়াদকাল শেষ হয়ে যায়। এ কারণে, প্রতিযোগিতা আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কেমন যেন দিশাহারা ভাব আর আত্মবিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে কারণও আছে। প্রতিযোগিতা আইনের বৈশ্বিক ইতিহাস অন্তত ১০০ বছরের পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এর প্রবেশ ঘটেছে খুবই সম্প্রতি এবং এ বিষয়ে কোনো একাডেমিক প্রশিক্ষণ ছিল না প্রায় কারোই।

আবার আইন অনুযায়ী প্রতিযোগিতা কমিশনে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের জন্য লাগবে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা আইন নিয়ে কারোই ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। কারণ, প্রতিযোগিতা কমিশনের বয়সই মাত্র আট বছর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র ৩২ বছর বয়সী লিনা খান। এই বয়সেই চেয়ারম্যান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বাঘা বাঘা সংস্থা যেমন ফেসবুক, আমাজন, গুগল ইত্যাদিকে ধরাশায়ী করছেন, তাঁদের প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিযোগিতা আইন বা অর্থনীতি নিয়ে কোনো একাডেমিক বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাই যেন মুখ্য হয় এসব জায়গায় নিয়োগের ক্ষেত্রে। আইনকেও যাতে সেভাবেই সংশোধন করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা কমিশনে নিয়োগের মেয়াদকাল অন্তত চার অথবা পাঁচ বছর করা খুবই প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশনের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা ব্যাপক, তবে তাতে বৈশ্বিক সেরা অনুশীলন প্রতিফলিত হয়নি। প্রতিযোগিতা আইনের যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে বিশাল অঙ্কের জরিমানা করে, জড়িত কোম্পানিগুলোর পরিচালকের পদ থেকে দায়ী ব্যক্তিদের সরিয়ে দেয়; আবার একই সঙ্গে দোষ স্বীকার করে অন্য জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিলে মওকুফও করে দিয়ে থাকে।

আমাদের আইন বৈশ্বিক এসব সেরা অনুশীলনকে সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। আবার প্রতিযোগিতা আইনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে, হাতেনাতে নথিপত্র সংগ্রহ করতে যদি কোনো কার্যালয়ে হঠাৎ পরিদর্শন করতে হয়, সেই ক্ষমতাও কমিশনের নেই। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে প্রতিযোগিতা আইনে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করার বিধান যুক্ত করতে হবে, অন্যথায় আমরা প্রত্যাশিত ফল আশা করতে পারি না।

নতুন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, তার মধ্যে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগামী গ্রাফের একমাত্র নয়, তবে অন্যতম কারণ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সত্যি বলতে এই সমস্যা কোনো নতুন সমস্যা নয়। সব সময়ই দেখা গেছে এই সমস্যার ক্ষণস্থায়ী সমাধান করা হয়েছে। তবে এর স্থায়ী সমাধানে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিযোগিতা কমিশন।

● আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক