যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল বিবেক মূর্তি। তাঁর দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অল্প বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন (মে, ২০২৩)।
বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩-১৭ বছর বয়সী ৯৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে; তাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি বলেছে, তারা প্রায় সারাক্ষণ এই মাধ্যমে কাটায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা, যোগাযোগ এবং বিনোদনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, এর অনেক ঝুঁকিও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, কিশোর-কিশোরীরা গড়ে প্রতিদিন সাড়ে তিন ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করে। যেসব কিশোর-কিশোরী এই মাধ্যমে দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সময় কাটায়, তাদের উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়।
কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা গবেষণায় জানা যায়, তিন সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার প্রতিদিন ৩০ মিনিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ফলে বিষণ্নতার তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
অল্প বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে নীতিনির্ধারক, গবেষক, মা–বাবা, কিশোর ও তরুণ বয়সীদের উদ্বেগ বাড়ছে।
বিবেক মূর্তির প্রশ্ন, ‘আমরা যদি নিরাপত্তার মানদণ্ড নির্ধারণ না করি এবং অল্প বয়সী ও তাদের বাবা-মায়েদের আরও সহায়তা না দিই, তাহলে এখন থেকে পাঁচ-দশ বছর পর পেছনে ফিরে বলব, তখন আমরা কী ভাবছিলাম?’
কিশোর-কিশোরীদের উপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা বয়সের তুলনায় অনুপযুক্ত এবং ক্ষতিকর কনটেন্ট খুব সহজেই পেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, নিজের ক্ষতি করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ গ্রহণসংক্রান্ত কনটেন্টের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অল্প বয়সীদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য ঘুম অপরিহার্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে ঘুমের সমস্যা এবং মনোযোগের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
কিশোর-কিশোরীদের জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে, তারা এই মাধ্যমে কতটুকু সময় কাটাচ্ছে, কী ধরনের কনটেন্টের সংস্পর্শে আসছে, এখানে তারা কী করছে, এই প্ল্যাটফর্মে অন্যদের সঙ্গে কেমন যোগাযোগ হচ্ছে ইত্যাদি।
সবাই একভাবে প্রভাবিত হয় না। ব্যক্তিপর্যায়ে একেকজনের সক্ষমতা ও ঝুঁকি একেক রকম। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে সেই বিষয়টিও ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে এর ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে তা জানা যায়।
ফেসবুকে পরিচয় হয়ে কোনো তরুণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার শিকারও হয়েছে।
কিশোরীরা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে আছে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে কিশোরীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এ বিষয়কে উপজীব্য করেই আই অ্যাম রুথ চলচ্চিত্র।
মেয়েকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য এক মায়ের সংগ্রাম নিয়েই কাহিনি। মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করা কেট উইন্সলেট জানিয়েছেন, তিনি নিজের কিশোরী মেয়েকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অনুমতি দেননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটালে কিশোরীরা অন্যদের সঙ্গে অনবরত নিজেদের তুলনা করতে থাকে। ফলে নিজস্ব চেহারা ও ওজন নিয়ে অসন্তুষ্টি বাড়ে; কারও কারও খাওয়াদাওয়াসংক্রান্ত মানসিক অসুস্থতা দেখা যায়। তাদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে।
দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার যাতে অল্প বয়সীদের জন্য ইতিবাচক হয় এবং তারা নিরাপদে অনলাইনের জগতে বিচরণ করতে পারে, সে জন্য সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানি, শিক্ষক, মা-বাবা এবং অভিভাবকদের দায়িত্ব আছে।
অনলাইনে শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে, সে বিষয়ে তাদের জানানোর জন্য বাংলাদেশে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইনে সুরক্ষাবিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এই শিক্ষা পেলে অল্প বয়সীরা ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমবিষয়ক পণ্য ও সেবা তৈরির সময় ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। কিশোর-কিশোরীদের জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে, তা প্রতিরোধে এই কোম্পানিগুলি খুব একটা সক্রিয় নয়।
কারণ, তারা মূলত মুনাফা দ্বারা তাড়িত। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
মা-বাবা সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিবারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমবিষয়ক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন। এতে থাকবে অনলাইন এবং বাস্তব কার্যক্রমের মাঝে ভারসাম্য রাখা, প্রতিদিন সর্বোচ্চ কতটা সময় অনলাইনে কাটানো হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগত তথ্য পোস্ট না করার মতো বিষয়।
প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইসমুক্ত থাকার চর্চা করা প্রয়োজন। পরিবারের সবাই মিলে খাবার সময় অথবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে কোনো ডিভাইস ব্যবহার না করা এবং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই ভালো।
সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন অথবা এর নেতৃত্বে আছেন এমন অনেকে নিজের পরিবারে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করছেন। পরিবারের সদস্যরা বসার ঘরে যাওয়ার আগে নিজেদের ডিভাইসগুলো একটা ঝুড়িতে রেখে যান, যাতে পারিবারিক আলোচনার সময় কারও মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটে।
অনলাইনের কার্যক্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। সন্তানদের সামাজিক এবং আবেগীয় দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে এবং তাদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলে মা-বাবা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটালে, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে মা-বাবা তাদের আগ্রহের বিষয় এবং বন্ধুবান্ধবসহ জীবনের নানা দিক নিয়ে জানতে পারবেন। তাহলে তারা বাস্তব ও অনলাইনের জগতে বিচরণের জন্য সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হবেন।
অল্প বয়সীরা বড়দের দেখেই শেখে। মা-বাবা এবং অভিভাবকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইনের পরিমিত ব্যবহার করলে কিশোর-কিশোরীরাও এতে কম সময় দেবে।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী