ন্যাটোকে কেন দ্বিগুণ চাঁদা দেয় যুক্তরাষ্ট্র

ছবি: রয়টার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প

নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) যুক্তরাষ্ট্রের পয়সায় চলে এবং সংস্থাটির বাকি সদস্যদেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের খরচে প্রায় মাগনা সুবিধা নিয়ে থাকে—এমন একটি ধারণার অস্তিত্ব ন্যাটোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প আটলান্টিক মহাসাগরীয় মিত্রদের প্রতিরক্ষা খাতে অল্প পরিমাণ ব্যয় করার জন্য বারবার সমালোচনা করেছেন। তাদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন। 

কিন্তু মনে রাখা দরকার, ইউরোপীয় মিত্রদের চাঁদা দেওয়া বাড়ানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুধু যে ট্রাম্প কথা বলেছেন, তা নয়। এর আগে ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার থেকে শুরু করে জন এফ কেনেডি, রিচার্ড নিক্সন, বারাক ওবামাসহ অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয়দের ন্যাটোতে আরও বেশি আর্থিক অবদান রাখার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। 

জার্মানরা যদি প্রতিরক্ষা খরচ না বাড়ায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তার মোতায়েন করা সেনার সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পারে—প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট এস ম্যাকনামারা এমন হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি খরচের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে মার্কিন পণ্য কিনতে রাজি হয়। 

কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির আগে পর্যন্ত, কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ন্যাটোর ‘বখাটে’ সদস্যরাষ্ট্রগুলোতে শায়েস্তা করতে বিদেশি হানাদারদের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে ন্যাটো মিত্রদের নিরাপত্তাকে সরাসরি বিপন্ন করেননি। ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক মন্তব্য খুবই বিভ্রান্তিকরভাবে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা-ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা এবং সরাসরি ন্যাটোকে অর্থ সরবরাহ করার বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলেছে। 

কিছু আমেরিকানের কাছে ট্রাম্পের এই উদ্বেগকে যৌক্তিক মনে হতে পারে। তাঁরা মনে করতেই পারেন, ভৌগোলিকভাবে প্রধান প্রধান সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে যে মুহূর্তে ন্যাটোর উপস্থিতি সরিয়ে আনা হচ্ছে, সে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন ন্যাটোর গড় মিত্রদের তুলনায় দ্বিগুণ চাঁদা গুনতে হবে? 

এই প্রশ্নের আংশিক জবাব হিসেবে বলা যায়, শুধু ন্যাটো কোথায় কতটুকু কাজ করছে তার ওপর ভিত্তি করে আমেরিকা সেখানে বিশাল সামরিক ব্যয় অনুমোদন করে না। দিন দিন বড় বড় শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে নিজের অতুলনীয় সামরিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য ধরে রাখার কৌশলগত উদ্দেশ্য থেকেও যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলে থাকে।

গ্রিসের মতো (যার প্রতিরক্ষা-ব্যয় আনুপাতিক দিক থেকে আমেরিকার চেয়েও বেশি), যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। বিশ্বজুড়ে যে ২০০টি (মোট মার্কিন ঘাঁটির ৯০ শতাংশ) মার্কিন ঘাঁটি সক্রিয় আছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সামগ্রিক মার্কিন সামরিক ব্যয়ের মাত্র ৪ শতাংশ।

ন্যাটো হলো একটি সাধারণ কল্যাণকর প্রতিষ্ঠান, যা থেকে সদস্যদেশগুলো সাধারণভাবে উপকৃত হয়; আর এর মধ্য দিয়ে মার্কিন সামরিক শ্রেষ্ঠত্বও প্রকাশিত হতে থাকে। 

ট্রাম্পের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘একটি ধারদেনা করে চলা দেশ’। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যে সামরিক বাহিনীতে অনেক ব্যয় করি, সেই সামরিক বাহিনী আমাদের জন্য কাজে আসে না। আর যেসব দেশ প্রতিরক্ষা খাতে পয়সা দিতে চায় না, তাদের মধ্যে অনেকগুলো দেশ অত্যন্ত ধনী।’ 

আদতে বেশির ভাগ আমেরিকান ন্যাটোকে সমর্থন করে থাকেন। তবে ট্রাম্পের অবস্থান সেই সব আমেরিকানের সঙ্গে মেলে, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক দায় দায়িত্বকে তাদের নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনৈতিক ভাগ্যের আলোকে দেখে থাকেন। তাঁদের মতো ট্রাম্পও মনে করেন, এসব সামরিক ব্যয় অহেতুক এবং এই ব্যয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত হচ্ছে ও সেই ঋণের বোঝা সাধারণ আমেরিকানদের ঘাড়ে চাপছে। 

কিন্তু বাস্তবতা হলো যাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন সামরিক ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের ঋণগ্রস্ত হওয়ার প্রাথমিক ‘চালিকা শক্তি’, প্রথমত, তাঁদের হাতে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, তাঁরা এই ধরনের সামরিক ব্যয়ের বিপরীতে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যায়, তা বুঝতে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছেন। 

ন্যাটো হলো মার্কিন নিরাপত্তা ছাতার এমন একটি চিপ বা যন্ত্র যা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় হুমকি দেখা দিলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সহায়তা দেয়। ন্যাটোতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।

এটি মার্কিন স্বার্থে সংঘাত ও সামরিক চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা হ্রাস করে। এই বৈশ্বিক নেটওয়ার্কটি মিত্রদেশগুলোর মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধা দেয়; যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় এবং এসবের মাধ্যমে চীন ও রাশিয়ার মতো কৌশলগত প্রতিযোগীদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে সমর্থন করতে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই শক্তি ব্যবহার করতে পারে; এবং সেটি তারা করেও। 

আমেরিকানদের এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণকে বিবেচনা করতে হবে। 

কার্লা নরলফ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও আটলান্টিক কাউন্সিলের একজন অনাবাসী জ্যেষ্ঠ ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ