চীন ও রাশিয়ার জোটকে থামানোর পথ কী?

কর্তৃত্ববাদী চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা জোট গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সর্বশেষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা যায়নি। এর কারণ হলো, ইউক্রেনীয় শিশুদের ওপর নৃশংস অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে এ বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। মস্কোর উদ্বেগ ছিল, জোহানেসবার্গে গেলে পুতিনকে আটক করা হতে পারে। নৃশংস অপরাধের মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও যুদ্ধাপরাধ। 

বিশ্ব আজ যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেখানে নৃশংস অপরাধ প্রতিরোধ জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। এ সংখ্যা অভূতপূর্ব। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনও নিশ্চিতভাবেই এর জন্য দায়ী। ভিন্নমতাবলম্বীদের রক্ষা করার বিষয়টি জাতিসংঘ তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করায় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা হওয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের চিত্র বলছে, সেই অগ্রগতি শুধু স্থবির হয়েই পড়েনি; মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নির্দিষ্ট করে বললে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য চীন ও রাশিয়ার মধ্যে উপকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তারা এ ধরনের নৃশংস অপরাধের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন

চীন ক্রমবর্ধমানভাবে যুদ্ধবাজ ও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর হুমকি তৈরি করছে এবং দেশের মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করছে। উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের নেওয়া পদক্ষেপ বিশ্বে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে।

গণহত্যা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ, গণ-আটক, সাংস্কৃতিক নিপীড়নের মতো অপরাধ সেখানে ঘটছে। একইভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ইউক্রেনের শহর বুচায় ব্যাপক হারে বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও গণনির্যাতনের ঘটনা দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকেই রাশিয়া এই যুদ্ধ করছে। 

কর্তৃত্ববাদী চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা জোট গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মস্কোয় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সর্বশেষ সফরে তিনি পুতিনকে বলেন, ‘এখন এমন সব পরিবর্তন ঘটেছে, যেটা ১০০ বছরেও ঘটেনি। আমরা যখন একত্রে আছি, আমরা এই পরিবর্তনকে চালিয়ে নিয়ে যাব।’

আরও পড়ুন

একবার ভেবে দেখুন তো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা বদলে এমন একটা বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হলো, যেখানে নেতৃত্ব দেবে দুই স্বৈরাচারী শক্তি। ইংরেজ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত সেই উক্তি থেকে ব্যাপারটি কল্পনা করা যেতে পারে, ‘তুমি যদি ভবিষ্যতের ছবি কল্পনা করতে চাও, তাহলে একটি ছবিই তোমার কল্পনায় আসবে, একটা বুট পরা পা চিরদিনের জন্য মানুষের মুখ চেপে ধরেছে।’

পুতিন ও সি একত্রে বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটাতে কাজ করছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশের উচিত মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক বিধিবিধান এবং জাতিসংঘ সনদের একেবারে মূল ভিত্তির (বিশেষ করে আগ্রাসনের ঘটনায়) ওপর যে বিশাল হুমকি তৈরি হয়েছে, সেটি অনুধাবন করা। 

এই হুমকি প্রতিরোধে চারটি করণীয় রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া ও চীন যেসব জনগোষ্ঠীর ওপর হুমকি তৈরি করছে, তাদের মধ্যে অবশ্যই সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। একটি সজাগ জনগোষ্ঠী মানবাধিকার রক্ষা ও অপরাধীদের জবাবদিহির মধ্যে আনার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।

নৃশংস অপরাধের তুলনায় অর্থনৈতিক স্বার্থ বড় নয়—এই রকম একটি কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। মস্কো ও বেইজিং মিলে বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দেশগুলোকে এক সুরে কথা বলতে হবে। এটা বলতে হবে যে এই পরিকল্পনা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য মৃত্যুঘণ্টার শব্দ।

দ্বিতীয়ত, নৃশংস অপরাধের তুলনায় অর্থনৈতিক স্বার্থ বড় নয়—এই রকম একটি কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। মস্কো ও বেইজিং মিলে বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দেশগুলোকে এক সুরে কথা বলতে হবে। এটা বলতে হবে যে এই পরিকল্পনা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য মৃত্যুঘণ্টার শব্দ।

তৃতীয়ত, ন্যায়বিচারের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যাতে সব অভিযোগের তদন্ত তারা করতে পারে এবং যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, অপরাধীদের যেন শাস্তি দিতে পারে। নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক আদালত যাতে কাজ করতে পারেন, সেই  পথ বের করতে হবে।

আরও পড়ুন

চতুর্থত, দেশগুলোকে অবশ্যই জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে যেতে হবে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যদি সশস্ত্র হামলা হয়, তাহলে সেই দেশের একার অথবা সামষ্টিকভাবে সব দেশের আত্মরক্ষার অধিকারটি সহজাত।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয় স্বীকৃতি দিতে হবে যে পরাশক্তিগুলো যেসব নিষ্ঠুর অপরাধ করে যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সত্যিকারের হুমকি তৈরি করছে। নিজেদের দেশের সীমানা ও বাইরের দেশে তারা যে গণহত্যার (সাংবাদিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নাগরিক অধিকারকর্মীদের আটকের কথা না–ই বললাম) মতো অপরাধ করছে, সেটা মানবতার জন্য বিপজ্জনক।

কাইল ম্যাথিউস কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মন্ট্রিয়ল ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক