পঁচাত্তর বছর পর বিশ্বকে কোথায় নিয়ে এল ‘১৯৮৪’

কেবল একটা বই পড়ে যদি কেউ একালের রাষ্ট্র ও রাজনীতি বুঝতে চান, তাহলে তাঁকে ১৯৮৪-এর বাইরে আর কিছু সুপারিশ করা কঠিন।

ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল ১৯৮৪ উপন্যাস লেখা শুরু করেন ১৯৪৪ সালে। কাজটা শেষ হয় তিন বছরে। প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দেন ১৯৪৮ সালে। পাণ্ডুলিপি জমার হিসাবে ১৯৮৪-এর ৭৫ বছর পূর্তি হবে এ বছর। বই আকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। সেই হিসাবে এর ‘প্লাটিনাম জুবিলি’ আগামী বছর।

গত ৭৫ বছরে বইটির কত কপি বিক্রি হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই কোথাও। সেই হিসাব রাখা সম্ভবও ছিল না। এর অনুবাদের ইতিহাসও বেহিসাবি। অনেক ভাষায় এর একাধিক অনুবাদ রয়েছে। এর প্রকাশনা স্বত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। বলা হয়, যেকোনো ইংরেজি উপন্যাসের চেয়ে এটা বেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়া বই। এ রকম ভাষার সংখ্যা অন্তত ৭০ হবে। কোথাও কোথাও এটা নিষিদ্ধও হয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়া দেশগুলোতে এর অনুবাদ হয়েছে বেশি।

সব ভাষাতেই এখনো মাঝেমধ্যে এটা বিক্রির তালিকায় ওপরে চলে আসে। দাবি করা হয়, প্রকাশের প্রথম দুই দশকেই যুক্তরাষ্ট্রে এই বইয়ের ৮০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে এটা ‘আমাজনে’র বেস্টসেলার ছিল।

কেবল একটি বই পড়ে যদি কেউ একালের রাষ্ট্র ও রাজনীতি বুঝতে চান, তাহলে তাঁকে ১৯৮৪-এর বাইরে আর কিছু সুপারিশ করা কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নজরদারি ও সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রকে উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাস এত জনপ্রিয় হওয়ার মধ্য দিয়ে সভ্যতা কী পেল? বিশ্বসমাজকে কোথায় নিয়ে এল ১৯৮৪? কীভাবে আমরা এই মহাগদ্যের প্লাটিনাম জুবিলি উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছি?

ভিন্নমত নির্মূল করা এক রাষ্ট্রের কল্পনা

পাঠকমাত্রই জানেন ১৯৮৪–এ জর্জ অরওয়েল এমন এক ‘ওশেনিয়া’ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে ভিন্নমত থাকবে না। ‘একদল’ এবং একজনই সেখানে সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেখানে প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাবিদার কেবল ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘বড় ভাই’। তাঁর অসংগতি খোঁজা বা কোনো কিছুতে আপত্তি তোলা হবে অপরাধ। সেই ‘অপরাধ’ সামলাতে ওশেনিয়ায় আছে ‘থট পুলিশ’ বা ‘চিন্তারক্ষী’রা।

সেখানে যত্রতত্র থাকে ‘চার্লিংটন’ নামের নজরদারি কর্মী দল। সংগত কারণেই ‘ওশেনিয়া’য় সাংবাদিকতার সীমা ‘প্রোপাগান্ডা’ পর্যন্ত। এই সীমা অতিক্রম করলে বিপদে পড়তে হয়। সীমার ভেতর থাকলে পুরস্কার ও উপহার আছে। কেউ সেখানে খুব একটা বিপদে পড়তে চায়ও না। বিপদ মানে কারাগার, নির্যাতন, চিন্তাশক্তি নষ্ট করার ব্যবস্থা।

অরওয়েলের কল্পিত ওই দেশে মন খুলে কথা বলার জন্য নাগরিক সমাজে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। ওখানে নিজের চোখ ও কানকে বিশ্বাস করাও অপরাধ হতে পারে। আর এ অবস্থা কায়েম করতে পুরো দেশে একটা ভীতির আবহ তৈরি করে রাখে ‘বড় ভাই’ ও তাঁর লোকজন।

মানুষ এখানে রোবটের মতো বেঁচে থাকে। বিনিময়ে তাদের অপরাপর জাতি ও ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের একটা ধারণা শুনিয়ে যাওয়া হয় যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব নিয়ে। যার রসদ হিসেবে পূর্বপুরুষদের নানান যুদ্ধস্মৃতি জাগিয়ে রাখা হয়। ১৯৮৪ -এর নায়ক-নায়িকা স্মিথ ও জুলিয়ার জীবনেও তাই ঘটে। প্রেম ও সংহতির (অরওয়েলের বর্ণনায় ‘ব্রাদারহুড’) জোরে তারা ওশেনিয়াকে বদলের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে। পরে ‘ব্রেনওয়াশে’র শিকার হয়ে আবার অনুগত নাগরিক হয়ে যায়। অর্থাৎ বড় ভাইয়ের ব্যবস্থা নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তাচর্চা থামাতে সফল হয় ওশেনিয়ায়।

জর্জ অরওয়েলের লেখা ১৯৮৪ উপন্যাসের প্রথম প্রচ্ছদ
ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে

প্রায় ৯০ হাজার শব্দের এই বই পড়তে পড়তে পাঠক তাড়াতাড়ি তাঁর সময়, তাঁর রাষ্ট্র, তাঁর চারপাশে হাজির হয়ে যান। তাঁরা তখন চারপাশে অগণিত স্মিথ ও জুলিয়াকে দেখেন। অরওয়েলকে তখন শুধু আর লেখক মনে হয় না, মনে হয় ভবিষ্যদ্বক্তা। ১৯৪৪ সালে দাঁড়িয়ে তিনি ১৯৮৪ সালকে কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো অরওয়েলের যাবতীয় বিবরণকে ‘২০২৩’ নাম দিয়েও বাজারজাত করা যায়। ‘২০২২’ দিয়েও প্রকাশ করা যেত।

কেবল উপন্যাস হিসেবে নয়, একালের বাস্তব সমাজের গবেষণা প্রতিবেদন হিসেবেও ১৯৮৪ এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রশ্ন হলো এ রকম অব্যর্থ অরওয়েলকে নিয়ে ২০২৩-এর বিশ্ব কি বিব্রত? লজ্জিত?

যে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে অরওয়েল ৭৫ বছর ধরে উলঙ্গ করে দেখাচ্ছেন, তাদের কখনো জামাকাপড় পরে লজ্জা নিবারণের বোধ তৈরি হলো না কেন? অরওয়েল কি তবে ‘আধুনিক’ মানুষের নিয়তিই বলে দিয়েছিলেন ৭৫ বছর আগে? এবং কথিত ‘মানবসভ্যতা’ অরওয়েলের বলে দেওয়া নিয়তির কাছেই দ্বিধাহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে?

অরওয়েলের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে একালের গণনজরদারির ব্যবস্থা

অরওয়েল ১৯৪৪ সালে লিখতে বসে তাঁর কল্পিত রাষ্ট্র ওশেনিয়ার ৪০ বছর পরের সর্বগ্রাসী এক নজরদারির চিত্র এঁকেছিলেন। তিনি দেখান, সরকার টিকে থাকতে গিয়ে নাগরিকদের চূড়ান্ত রকমে অরক্ষিত করে ফেলছে। কেবল ভয় নয়, চূড়ান্ত এক অসম্মানের সংস্কৃতিতে বেঁচে থাকে ওশেনিয়ার মানুষ (পড়ুন ‘প্রজারা’)। ১৯৮৪ লেখার ৭৫ বছর পর দেখা যাচ্ছে বিশ্বে ওশেনিয়ার সংখ্যা অনেক। আরও সরাসরি বললে সবাই ওশেনিয়া হওয়ার পথে। সাহিত্যের আবরণে অরওয়েল জানাতে চেয়েছিলেন সতর্কবার্তা; অথচ ‘বড় ভাইয়ে’রা সেটাকেই তাঁদের স্বপ্নের ‘সিস্টেম’ বানিয়ে নিয়েছেন।

সম্ভাব্য নজরদারি যন্ত্র হিসেবে অরওয়েল তাঁর দেশটিতে ‘টেলিস্ক্রিনে’র কল্পনা করেছিলেন। অনেকটা তাঁর কল্পনার প্রতি শ্রদ্ধা (!) রেখেই বিশ্বজুড়ে সার্ভিলেন্স ক্যামেরার সংখ্যা এখন এক বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। প্রতি আটজনের জন্য অন্তত একটা নজরদারি ক্যামেরা কাজ করছে এই মুহূর্তে। কিছু কিছু দেশে শিগগিরই এ রকম ক্যামেরার সংখ্যা জনসংখ্যার সমান হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে প্রতি ১০০ মানুষের জন্য গড়ে ১৪-১৫টি করে ক্যামেরা কাজ করছে। কেবল ক্যামেরা নয়, শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে নয়, আরও বহু ধরনের নজরদারি প্রযুক্তি স্থাপিত হয়ে আছে নাগরিকদের সামনে-পেছনে-পকেটে।

কাউকে আওতার মধ্যে দেখার জন্য মোবাইল ফোন যন্ত্রটিই একালে যথেষ্ট। এ যন্ত্র ছাড়া মানুষ এখন আর নিজেকে কল্পনা করতে পারে না। এটাকে আধুনিকতা ও স্মার্টনেসের অংশও মনে করা হচ্ছে বা মনে করানো হয়। এই যন্ত্র সচলভাবে সঙ্গে থাকার মানেই ‘বড় ভাই’ জানবে আপনি কোন ‘টাওয়ারে’র অধীনে আছেন। তাঁর জানা-বোঝা আরও সহজ করতে যখন ইচ্ছা যে কারও মোবাইল ফোনে নজরদারি প্রযুক্তি ঢুকিয়ে রাখা যায় ব্যবহারকারীর অজান্তেই।

জর্জ অরওয়েল যে বছর ১৯৮৪-এর পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে জমা দেন, সে বছরই জাতিসংঘে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হয়। ওই ঘোষণাপত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ ছিল ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার [ধারা ১২], ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা [১৮] ইত্যাদি। ১৯৮৪–এর প্লাটিনাম জুবিলির কাছাকাছি সময়ে ওই অর্ধমৃত দলিলটিরও ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। পৃথিবী প্রকৃতই দারুণ কৌতুকময়।

জর্জ অরওয়েলের জন্মস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও এ রকম নজরদারি যন্ত্রপাতি বসানোর জোয়ার বইছে এখন। ‘ফিউচার মার্কেট ইনসাইট’ নামের একটা সংস্থার জরিপ-অনুমান হলো, ২০২৩ সালে নজরদারি যন্ত্রপাতির বিশ্ববাজারের আকার প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার।

চলতি দশকের মধ্যে এটা ৩০ বিলিয়ন ছাড়াবে। এই ‘বাজারে’র বড় ক্রেতা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তার পরিচালক বড় ভাইয়েরা। শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তার নামে এবং ‘জনস্বার্থে’ই এসব কেনাকাটা চলছে। বিশাল নজরদারি–কাঠামো ছাড়া এখন আর কোনো ‘রাষ্ট্র’ কল্পনা করা যায় না। ‘শক্তিশালী রাষ্ট্রে’র গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে কার কত শক্তপোক্ত নজরদারি–কাঠামো আছে; কতটা সফলভাবে সে প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে!

তবে অরওয়েলের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে একালের ‘ওশেনিয়া’। বাড়ি-হাটে-মাঠে-অফিসে প্রত্যেক নজরদারি যন্ত্র খুদে খুদে আরও অনেক ‘কর্তৃপক্ষে’র কথাও জানায় এখন। ‘ব্যক্তি’র যাবতীয় বিবরণ জানা ‘বড় ভাইয়া’দের পাশাপাশি আরও অনেকের দরকার। বিভিন্ন উৎপাদক কোম্পানির পণ্য বিপণনের জন্যও নজরদারির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য লাগে। একালে ‘ব্যক্তি’মাত্রই এক নগ্ন ভোক্তাও বটে।

আরও পড়ুন

‘জনস্বার্থে’ মানুষ যখন ‘নগ্ন’

১৯৮৪ প্রকাশের পরের বছরই অরওয়েল মারা যান। বেঁচে থাকলে তিনি দেখতেন ‘বৈধ’ভাবে নজরদারি করতে এবং নজরদারির যন্ত্রপাতি বসাতে অনেক ওশেনিয়াতেই এখন আইনি কাঠামোও আছে।

কোনো কোনো ভিন্নমতাবলম্বীর দাবি, এসব আইন রাজনৈতিকভাবে ‘প্রজা’দের ‘সম্ভাব্য অপরাধী’ ধরে নেয়। অনুগত রাখতে তাদের সামনে বিবিধ দণ্ডের বিবরণ হাজির রাখা হয়। ‘অপরাধে’র সংজ্ঞাও ওশেনিয়ার শাসকেরাই ঠিক করেন। এ সংজ্ঞার ভেতর থাকে বিবিধ ‘ভাবমূর্তি’ ও ‘অনুভূতি’র দোহাই। এসব দোহাই, অপরাধ ও আইনের সঙ্গে মিল রেখে একালে বিশ্বজুড়ে নজরদারি প্রযুক্তির ‘বিকাশ’ ঘটে চলছে।

বাস্তব জগতের শরীরী মানুষদের জন্য থাকছে ক্যামেরাসহ নানান প্রযুক্তি, আর সাইবার–জগতে থাকাদের জন্য আছে ‘স্পাইওয়্যার’ নামের নানান অদৃশ্য চোখ-কান। মোটাদাগে বর্তমান কালকে নজরদারি সফটওয়্যারের যুগ বলা যায়। ব্যক্তি জানে না কখন তার কম্পিউটারে ‘ফিশিং সফটওয়্যার’ ঢুকেছে। কখন তার ইন্টারনেট সার্ভারে ‘জ্যামার’ বসছে। অনেক ‘ওশেনিয়া’তেই নজরদারিব্যবস্থা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে।

আরও পড়ুন

প্রতিবাদকারীদের দাবি, নজরদারি প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে তার অজান্তে পুরোপুরি ‘নগ্ন’ রাখা হয়। এই নগ্নতার মানে প্রাইভেসি–হারা ‘প্রজা’র প্রতিদিন প্রতিক্ষণে অসম্মানের শিকার হওয়া। তার বা তাদের কিছু আর ব্যক্তিগত নেই। আড়াল নেই। নিজস্ব নেই। ব্যক্তির ‘স্বাধীনতা’, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি কৌতুককর শব্দ হয়ে যাচ্ছে অরওয়েল-কল্পিত একালে।

আরও কৌতুককর হলো এই ব্যাপারগুলো অজানা নেই কোনো প্রজার। ২০২৩ সালের বিশ্বে এ কথাগুলো মোটেই নতুন নয় আর। সবাই জানেন এসব। ওই জানা মানুষগুলোই নতুন করে ১৯৮৪ পড়ে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখে বিষণ্নতায় ভোগেন। এই নগ্ন পাঠককে সব জেনেবুঝে বড় ভাইদের কর্তৃত্বেই থাকতে হয়। সবার চিন্তাশক্তি থেকে স্বশাসনের শক্তিটুকু কেড়ে নিয়েই একালের ওশেনিয়াগুলো টিকে থাকে।

ভুল তথ্য ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রজাদের মোহাবিষ্ট করাও একালের ওশেনিয়ার ‘ভাইয়া’দের বড় এক কারিগরি কর্মসূচি। নিজের চোখ ও কানে ধরা পড়া সত্যকে বিভ্রম বলে উড়িয়ে দিয়ে অনুগত ভঙ্গিতে ‘অনুমোদিত তথ্যে’র ভোক্তা হতে হয়। সেসব তথ্য শোনাতে আছে অগণিত টিভি ও পত্রিকা। অরওয়েল যখন ১৯৮৪ লিখছিলেন, তখন টেলিভিশন সেটের সংখ্যা ছিল হাজারের ঘরে।

এখন এর সংখ্যা প্রায় ১৭০ কোটি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কম্পিউটার ও মোবাইল স্ক্রিন। ঘুমের বাইরে প্রতিদিন মানুষ যতটা সময় জেগে থাকে, তার পুরোটাই তাকে নানান তথ্য-সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা আছে। কতবার আর শ্রোতা চারদিকের বয়ান অবিশ্বাস করবেন। একসময় চলতি ‘সিস্টেম’কে তার মহান মনে হবেই। এবং ‘ভাইয়া’দেরও!

প্রজার নীরব এই ‘সম্মতি’ই তার নিয়ন্ত্রণ ও দমনের সরব শর্ত তৈরি করে এবং ১৯৮৪ লেখার ৭৫ বছর পরে এসব শুনতে গিয়ে মোটেই বেখাপ্পা লাগে না পাঠকের। সিসিটিভি ছাড়া কোনো প্রশাসন কল্পনা করা যায় না আজ আর। সুতরাং অরওয়েলকেও কল্পকাহিনির লেখক মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং নিজের ভবিষ্যদ্বাণীর ৭৫ বছর পূর্তিতে বেঁচে থাকলে জর্জ অরওয়েল হয়তো কেবল হাসতেন।

সেই হাসির শব্দ আস্তে আস্তে অট্টহাসি হয়ে সব চার দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলত। এখনো হয়তো আজ ও আগামীকালের সব স্মিথ ও জুলিয়া সেই অট্টহাসির শব্দ টের পাচ্ছেন। বাকিরাও পাবেন। কিন্তু কেউ কি কোথাও তৈরি হচ্ছে? অরওয়েলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবে, হাসি থামান, ‘২ +২= ৫’ এটা আমরা বহুকাল দম বন্ধ করে মেনে চললেও এখন আর বিশ্বাস করছি না। দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। ‘ব্রাদারহুড’ অলীক কল্পনা নয়।

এভাবে অরওয়েলের অট্টহাসি না থামিয়ে আর কীভাবে ১৯৮৪–এর প্লাটিনাম জুবিলি উদ্‌যাপিত হতে পারে? আরও আরও কিছু ‘বৈধ’ নজরদারি আইন বানিয়ে? ‘বৈধ’ভাবে আরও নজরদারি যন্ত্রপাতি কিনে? ‘বড় ভাইয়া’দের ইচ্ছার কাছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়ে?

পুনশ্চ

জর্জ অরওয়েল যে বছর ১৯৮৪-এর পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে জমা দেন, সে বছরই জাতিসংঘে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হয়। ওই ঘোষণাপত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ ছিল ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার [ধারা ১২], ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা [১৮] ইত্যাদি। ১৯৮৪–এর প্লাটিনাম জুবিলির কাছাকাছি সময়ে ওই অর্ধমৃত দলিলটিরও ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। পৃথিবী প্রকৃতই দারুণ কৌতুকময়।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক