জনসাধারণের পার্কে বিশ্বের প্রথম কফি শপ!

কফি শপটি পার্কের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়

জনসাধারণের পার্কে সম্ভবত বিশ্বের প্রথম কফি শপ (আমার জানামতে) স্থাপনের গৌরব অর্জন করতে চলেছে গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্ক! জনগণের অর্থে নির্মিত একটি ভবনে, কফি শপ চেইন ‘নর্থ অ্যান্ড কফি রোস্টার্স’–এর একটি শাখা এই পার্কে বৃহস্পতিবার চালু হয়েছে। এমনিতেই বাগাড়ম্বর আর অসম্মানজনক তালিকায় শীর্ষ স্থান দখলে আমাদের জুড়ি নেই।

যেমন বসবাসের অযোগ্য নগরী বা দূষণপূর্ণ নগরীর তালিকার শীর্ষে আমাদের অবস্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র হয়ে জেনেছিলাম, আমাদের ছাত্রাবাস এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রাবাস। পরে জেনেছি, তথ্যটি সঠিক নয়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ইত্যাদি নিয়ে বাগাড়ম্বরের প্রধান কারণ হলো এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত নির্মাণ ব্যয় ও বাস্তবায়নে বিলম্ব আড়াল করা।

তবে জনসাধারণের পার্কে বিশ্বের প্রথম কফি শপ স্থাপনের গৌরব অর্জনের দাবিটি মোটেই বাগাড়ম্বর নয়। বরং এটি একটি রূঢ় বাস্তবতা হতে চলেছে!

আরও পড়ুন

ব্যক্তিগত ও জনসাধারণের সম্পত্তির পার্থক্য

ব্যক্তিগত সম্পত্তি, প্রযোজ্য আইন ও বিধি মেনে যেকোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় এবং এতে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু জনসাধারণের সম্পত্তি (যেমন পার্ক) কেবল নির্ধারিত প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় এবং সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত হতে হয়। এমনকি আইনে বলা আছে যে জনস্বার্থে যদি কোনো জমি অধিগ্রহণ করে কোনো সংস্থাকে দেওয়া হয়, যে উদ্দেশ্যে জমিটি দেওয়া হয়েছিল, সে উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করলে তা সরকারকে ফেরত দিতে হবে।

পার্কের বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি

পার্কের বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে যুক্তি হলো, পার্ক রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বেড়েছে। তাই পার্কের সুবিধা অব্যাহত রাখতে সরকারের অপ্রতুল বরাদ্দের সম্পূরক হিসেবে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, সে জন্যই বাণিজ্যিকীকরণ। এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। এ ধরনের যুক্তি গ্রহণ করলে, কেউ দাবি করতে পারেন, জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গভবনের এক অংশে পাঁচতারা হোটেল, ক্যাসিনো ও গলফ কোর্স স্থাপন করে আয় বাড়িয়ে সরকারের বাজেট ঘাটতি কমানো যেতে পারে।

তাই কোনো অবস্থাতেই পার্কের মতো জনসাধারণের স্থাপনার বাণিজ্যিক ব্যবহার যুক্তিসংগত নয়। বিদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা পার্কে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তাঁদের অর্থায়নে সম্পন্ন কাজের জন্য ফলকে দাতাদের নাম উল্লেখ বা তাঁদের প্রিয়জনের নামে উৎসর্গ করা হয়। তাই বিদেশে পার্কের চেয়ারে বসতে গিয়ে দাতার নাম উল্লেখ থাকতে দেখেছি।

পার্কে কফি শপ হলে সমস্যা কোথায়

এক. প্রধান সমস্যা হলো, এর ফলে পার্কের অংশবিশেষে সর্বসাধারণের প্রবেশ সীমিত হয়ে পড়বে। নর্থ অ্যান্ড কফি শপে এক পেয়ালা কফির সর্বনিম্ন মূল্য ১৬৫ টাকা থেকে ৫০০ টাকার বেশি। অন্যান্য খাবারের দামও অনুরূপ। তাই উচ্চ মূল্যের জন্য এ কফি শপে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

দুই. কফি শপটি পার্কের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পার্ক ক্যালরি বার্ন করার, উদরপূর্তি করার জায়গা নয়।

আরও পড়ুন

কেবল কফি শপ নয়

নর্থ গুলশানের লেক পার্কের বিশাল স্থাপনাজুড়ে বসেছে আইসিডিডিআরবির রক্ত ও অন্যান্য নমুনা সংগ্রহের কেন্দ্র। লেক পার্কে আগে থেকেই আছে চা, আইসক্রিম, কোমল পানীয় ও হালকা খাবারের দোকান। এ ছাড়া আছে পার্কভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাবের নিজস্ব স্থাপনা। এগুলোও আইনসিদ্ধ নয় বলে অনেকে মনে করেন।

ভালো দৃষ্টান্ত

গুলশানের সব পার্কেই যে বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে, তা নয়। ভালো দৃষ্টান্তও আছে। শহীদ তাজউদ্দীন পার্কে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল শেষে তারা খেলার মাঠে দোলনায় দোল খাচ্ছে, নাগরদোলা ও অন্যান্য খেলার সরঞ্জাম দিয়ে খেলছে। খেলা শেষে তাদের পাউরুটি, শিঙাড়া, কলা, পিঠা—একেক দিন একেক খাবার দেওয়া হয়। একদিন দেখলাম ক্লাব সভাপতির কানাডায় শিক্ষারত ছেলে ছুটিতে বেড়াতে এসে শিশুদের পড়াচ্ছেন, ওদের সঙ্গে খেলছেন এবং আহার গ্রহণ করছেন। অথচ এই পার্কের একাংশে আগে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক ওয়ান্ডারল্যান্ড ছিল, একটা খাবারের দোকান ছিল। এখন এর সবই অতীত, দেখে মন ভালো হয়ে গেল!

স্মার্ট বাংলাদেশ হলে কী করা হতো

তাহলে কি পার্ক ব্যবহারকারীরা কফি পান করতে পারবেন না? রোগনির্ণয়ের জন্য তাঁদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করাবেন না? অবশ্যই করাবেন। তবে তা হতে হবে পার্কের বাইরে। বিদেশভ্রমণে পারদর্শী স্মার্ট বাংলাদেশের প্রবক্তারা বাইরে দেখে থাকবেন, পার্কের পাশেই রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ ভ্যানগাড়িতে কফি, আইসক্রিম, সোডা ও নানান খাবারের ভেন্ডিংয়ের ব্যবস্থা। তাঁরা আরও দেখে থাকবেন, ভ্যানগাড়িতে কোভিড-১৯–এর নমুনা সংগ্রহ। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসব গাড়িতে রক্তসহ অন্য যেকোনো নমুনা ল্যাবে পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এ ধরনের একটি ভ্রাম্যমাণ ভ্যান গুলশান, বনানী, বারিধারার সব পার্ক থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে। স্মার্ট বাংলাদেশের পথ এটাই, জনসাধারণের পার্কে বাণিজ্যিক স্থাপনা হচ্ছে উল্টোযাত্রা।

নাগরিক প্রতিবাদ নেই

আমাদের দেশে রাজনীতির বাইরে নাগরিক প্রতিবাদের ধারাটি বেশ ক্ষীণ। দ্রব্যমূল্যের জন্য কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) থাকলেও তারা ততটা সংঘবদ্ধ নয়। এসব সংগঠনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়নি, যেমনটি করা হয়েছে ব্যবসায়ী সংগঠন যেমন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিএবির মতো সংগঠনগুলোকে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ক্যাব ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বাপার সঙ্গে আলোচনা ও   পরামর্শ গ্রহণ সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় সরকারের সংগঠনের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

পার্কসমূহের জবরদখল এড়ানো ও বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে বাপার মতো সংগঠনগুলোকে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অন্য যেকোনো দেশে পার্কের এ ধরনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে পিকেটিং হতো, আদালতে মামলা হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে গণতন্ত্র মানে আগামী পাঁচ বছর কোন দলকে লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ! অথচ প্রকৃত গণতন্ত্রের দাবি হলো, সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও দেশ পরিচালনায় নাগরিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

আমাদের আরও প্রত্যাশা, মাননীয় আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পার্কের বাণিজ্যিকীকরণ ও অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে ও জনসাধারণের পার্ক ব্যবহারের নীতিমালা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেবেন। এটা করা না গেলে দেখাদেখি সব পার্ক বাণিজ্যিক স্থাপনায় ভরে যাবে এবং উপযোগিতা হারাবে।

আমাদের দাবি ও প্রত্যাশা

সাহাবুদ্দিন পার্কে কফি শপ ও লেক পার্কে আইসিডিডিআরবির নমুনা সংগ্রহের কেন্দ্র স্থাপনের বেআইনি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। নর্থ অ্যান্ড কফি রোস্টার্স তাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। যা–ই হোক না কেন, জনসাধারণের পার্কের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পার্কের পরিবেশ রক্ষা ও শিশুদের জন্য নিরাপদ করতে হবে। লেক পার্কের নমুনা সংগ্রহের কেন্দ্রটিকে একটি সাধারণ পাঠাগারে রূপান্তর করা যেতে পারে।

আমাদের আরও প্রত্যাশা, মাননীয় আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পার্কের বাণিজ্যিকীকরণ ও অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে ও জনসাধারণের পার্ক ব্যবহারের নীতিমালা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেবেন। এটা করা না গেলে দেখাদেখি সব পার্ক বাণিজ্যিক স্থাপনায় ভরে যাবে এবং উপযোগিতা হারাবে।

কংক্রিটের জঞ্জালমুক্ত হোক আমাদের পার্কগুলো। পার্ক হোক বৃক্ষের, ঘাসের, ফুল ও প্রজাপতির। আমরা পত্রপল্লবে সুশোভিত, পাখি, শিশু, যুবা ও বুড়োদের কলতানে মুখর ও চঞ্চল পার্ক দেখতে চাই।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব