প্রধানমন্ত্রীর পোষা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রোপাগান্ডা ছড়ানো যার কাজ

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান

হাঙ্গেরির রক্ষণশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাথায়াস করভিনাস কলেজিয়ামে (এমসিসি) ভিক্তর ওরবানের দক্ষিণপন্থী সরকার অনুদান দেয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ বড় হচ্ছে। হাঙ্গেরির বাইরেও কার্যক্রম শুরু করেছে। ব্রাসেলসে শাখা খোলার পর ভিয়েনায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় কিনেছে মালিকপক্ষ। পরিকল্পনা আছে লন্ডনসহ পশ্চিম ইউরোপীয় অন্যান্য দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম বিস্তৃত করার। 

আমি বুদাপেস্টে এমসিসির ফেলোশিপ করেছিলাম গত বছর। এর বিস্তার দেখে একটু উদ্বিগ্নই হলাম। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টি চলে ভিক্তর ওরবানের দেখানো পথে। ওরবানের মতাদর্শ ছড়াতে পারবেন এমন শিক্ষাবিদদের তাঁরা অনুদান দেন। এককথায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কাজ ইউরোপ ও এর বাইরে ওরবানের প্রভাব বাড়ানো। 

এমসিসির টাকার অভাব নেই। ২০২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে। যাঁরা ওরবানের ধ্যানধারণার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন, তাঁদের জন্যও এমসিসি যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তা ফেরানো কঠিন। টাকাপয়সা তো অঢেল, সঙ্গে আছে বৃত্তি, আবাসন, দামি রেস্তোরাঁয় ডিনারের নিমন্ত্রণ, দেশের বাইরে ভ্রমণসুবিধাসহ আরও অনেক কিছু।

হাঙ্গেরির লোকজনের জন্য, বিশেষ করে হাঙ্গেরির গ্রামের ছেলেদের জন্য সামাজিক উত্তরণ অনেকটা কঠিন। এমসিসি এই সুযোগই নিচ্ছে। তারা এমন ছেলেমেয়েদের তুলে এনে মোটামুটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে। আমাকেও তারা এসব সুযোগ দিয়েছিল। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেওয়া এবং বুদাপেস্টের একটা আরামদায়ক ফ্ল্যাটে বসবাসের সুযোগ। কিন্তু এর বদলে প্রতিষ্ঠানটি আমার কাছে ডানপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হব এমন একটা প্রতিশ্রুতি আশা করেছিল।

আরও পড়ুন

আমি সুযোগটা নিয়েছিলাম। কারণ, এমসিসি তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে আমার লেখাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছিল। কিন্তু আমি বুঝলাম তারা আমাকে কিছু শর্ত দেবে। এমসিসিতে আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক যা বলবেন, তা–ই করতে হবে বিষয়টি ছিল এমন। আর বিষয়গুলো ছিল এমন, যাতে করে ভিক্তর ওরবানের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হয়। যেমন আমাকে বলা হয়েছিল হাঙ্গেরি সীমান্তে অবস্থানকারী ইউক্রেনীয় ও সিরিয়ার শরণার্থীরা কোন প্রেক্ষাপটে এসেছে, তা নিয়ে একটি তুলনামূলক লেখা দাঁড় করাতে। তারা চাইছিল আমি যেন ২০১৫ সালে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে না চাওয়ার যে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ওরবান নিয়েছিলেন, তার পক্ষে লিখি।

আমার সঙ্গে ওই একই কর্মসূচিতে আরও তিনজন ফেলো ছিলেন। আমি দেখলাম আমেরিকার একজন ফেলো, যিনি কখনো হাঙ্গেরিতে আসেননি, তিনি ক্লাসের ওই পাঠের ওপর ভিত্তি করে একটা প্রবন্ধ লিখে বসলেন। রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আমি একজন শিক্ষককে বক্তৃতা দিতে শুনলাম। এরপরই আমার এক সহকর্মী কেন রাশিয়ার তেল কিনে হাঙ্গেরি কোনো ভুল করেনি তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে লিখলেন।  

আরও পড়ুন

আমার মনে হলো ওরা আমেরিকানদের দিয়ে ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে ওরবানের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের কাজ করছে। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরাও ছিলেন ওখানে। তাঁরাও নিজ নিজ ভাষায় ওরবানের পক্ষে লিখলেন। 

আমি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এসব চাতুরীমূলক লেখা লিখতে এই ফেলোশিপ নিইনি। তাই যে যে বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল, যেমন রাজনৈতিক দুর্নীতি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলাম। আমি আমার নিবন্ধের বিষয় কী হবে, এমসিসি প্রশাসককে জানালাম। তিনি বারবার একটি শব্দই ব্যবহার করলেন, ‘খুব সাবধান।’

এমসিসি আমার লেখাগুলোতে নিজেদের রাজনৈতিক মতের প্রতিফলন দেখতে চাইল, সম্পাদনার পর সম্পাদনা হতে লাগল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাধীনভাবে লিখব ও প্রকাশ করব। নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি হাঙ্গেরির বাইরে লেখাগুলো ছাপানোর উদ্যোগ নিলাম। এক বন্ধু আমাকে বললেন, আমার কাজগুলো ওরা নজরদারি করছে। আমি সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে ছিলাম। একেক সময় এই বোধ আমাকে এমন ভীত করে তুলল যে দু–দুবার আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়ে গেল। 

যখন ফেলোশিপের মেয়াদ শেষ হলো, আমার সতীর্থদের এমসিসির অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাভজনক কাজের সুযোগ দেওয়া হলো। এমসিসির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারে তাঁরা কাজ করেছিলেন, সে জন্যই এই পুরস্কার।

ওরবানের দেখানো পথে চললে পুরস্কার পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তাঁর দল দেশের ৭০–৮০ ভাগ সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক। দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় দলটির মিত্রদের হাতে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন তারা বাইরে পাড়ি জমাতে চাইছে। 

গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

বেনস জি সেচেইনি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অব জার্নালিজমের শিক্ষার্থী এবং বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরির ফুলব্রাইট স্কলার