কলিম, বেলাল, তানভিরদের কান্নায় কি গলবে পাথর

মালয়েশিয়া যেতে উড়োজাহাজের টিকিট ছাড়াই হাজারো মানুষ ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ভিড় করেনফাইল ছবি: প্রথম আলো

‘তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে। এমপি জানি না, চিনি না, রিক্রুটিং এজেন্সি চিনি। দায়ী হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে’—প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী যখন এই সরকারি বয়ান ঝাড়ছিলেন, তখন প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আপলোড করা একটি ভিডিও নিউজে দেখা যাচ্ছিল, বরিশাল থেকে আসা মোহাম্মাদ কলিম নামের এক তাজা তরুণ বিমানবন্দর সড়কে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘সুদের ওপর ঋণ নিয়ে টাকা দিয়েছিলাম। এখন মালয়েশিয়া যেতে পারলাম না। মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ নাই।’

কক্সবাজার থেকে আসা বেলাল হোসেন বলছিলেন, ‘কিছু টাকা বাবা দিছে। কিছু চাচারা ভিটা বন্ধক দিয়ে দিছে। আর কিছু গরু বেচার টাকা। এই সব টাকা মাইর গ্যাছে। কী করব জানি না।’

আরও পড়ুন

প্রতিমন্ত্রী যখন ‘তদন্ত সাপেক্ষে’ ‘ব্যবস্থার’ আশ্বাস দিচ্ছিলেন, তখন প্রথম আলোর আরেক খবরে দেখা যাচ্ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মাত্র ২২ বছরের তাজা তরুণ ছেলে তানভির মিয়া মালয়েশিয়া যেতে না পেরে বিমানবন্দর থেকে আন্তনগর উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলেন।

পথে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলসেতু অতিক্রমের সময় ট্রেনের দরজা থেকে মেঘনা নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন।

বরিশাল থেকে আসা মোহাম্মাদ কলিমের মতো তানভির মিয়ার মাথায় আত্মহত্যার ইচ্ছা ভর করেছিল কি না এবং তাঁর এই ‘পড়ে যাওয়া’র পেছনে সেই ‘ইচ্ছা’র কোনো হাত ছিল কি না, তা আমরা জানতে পারিনি।

তবে জানতে পেরেছি, তানভিরের বাবা মেরাজ মিয়া প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। তিনি আকাশ ফাটানো চিৎকারে বলেছেন, ‘আমার ছেলের আজ মালয়েশিয়ায় থাকার কথা। আর এখন আছে পানির তলে।’

এই রকম হাজার হাজার (এমনকি সংখ্যাটা লাখ ছাড়াতেও পারে) কলিম, বেলাল, তানভির তাঁদের ঘটি-বাটি খুইয়ে জোগাড় করা টাকা রিক্রুটিং এজেন্সির ক্যাশ বাকসে জমা করেও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি।

আরও পড়ুন

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব বলছে, চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি ১৬ হাজার ৯৭০ জন।

বিএমইটির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় যেতে পারেননি মোট ৩১ হাজার ৩০৪ জন। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো সংস্থাগুলোর সংগঠন বায়রার কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হবে।

আর মাঠপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, এই সংখ্যা এক লাখের বেশিও হতে পারে।

সরকার যে খরচ ধরে দিয়েছিল, তাতে মালয়েশিয়ায় যেতে একজন শ্রমিকের ৭৯ হাজার টাকার বেশি লাগার কথা না। কিন্তু সবাই জানে, কোটি কোটি দেশপ্রেমিকের এই দেশে ‘সরকারি’ কথাটি নেহাত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছু না।

ফলে কলিম, বেলাল, তানভিররা সরকারি হিসাব বাদ দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন।

খবরের কাগজে পড়লাম এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখলাম, ধানের জমি বেচে, বসতভিটে বন্ধক দিয়ে, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি বেচে, ‘সমিতি’র কাছ থেকে সুদে ধার এনে জোগাড় করা টাকা দিয়ে তিন-চার গুণ বেশি দাম দিয়ে প্লেনের টিকিট কিনেও তাঁরা মালয়েশিয়া যেতে পারলেন না।

মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য শুক্রবার বিমানবন্দরে অপেক্ষারত কয়েকজন
ছবি: প্রথম আলো

জমি বন্ধক রাখা বা বিক্রির হালাল টাকা দিয়েও যখন মানুষগুলো প্লেনে উঠতে পারলেন না; ঠিক তখন দেখলাম, সেই গরিব মানুষের জমি দখল করে নেওয়া একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলার মধ্যেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্লেনে উঠে বিদেশে চলে গেলেন। কেউ তাঁকে আটকাতে পারল না।

আজকে হাজার হাজার মানুষ যাঁদের কারণে পথে বসে গেলেন, তাঁরা কারা তা ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি। আমরা জেনে গেছি, মালয়েশিয়া ও এ দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট বা চক্রের কারণে এই বিপদ নেমে এসেছে।

এই চক্রের মধ্যে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে জনবান্ধব ভাষণ দেওয়া এমপিরাও আছেন। অন্তত চারজন সংসদ সদস্য এই চক্রের মাধ্যমে তাঁদের ব্যবসা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছেন।

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এই যৌথ চক্রচর্চার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে আপাতত আর লোক নেবে না। এর আগে ২০০৯, ২০১৬ ও ২০১৮ সালেও একইভাবে চক্রের কারণে বন্ধ হয়েছিল দেশটির শ্রমবাজার।

চারবার একই কারণে একই দেশের শ্রমবাজারের দরজা মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল—এটি যে লজ্জা-শরমের বিষয়, তা সরকার কতটুকু বুঝতে পেরেছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

প্রতিবারই ঘটনা ঘটার পর টেবিলের ওপর সাজানো কতকগুলো বুম আর মাইক্রোফোনের সামনে বসে কোট–প্যান্ট পরা কর্তাব্যক্তিরা যথারীতি হম্বিতম্বি করে ‘তদন্ত কমিটি হচ্ছে’ এবং ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’ মার্কা কথা বলে যাচ্ছেন।

পাবলিকের কাছে এসব সরকারি কথার যে চার পয়সার দাম নাই, তা সবাই জানে। যে চক্রের কারণে এতগুলো মানুষ পথে বসে গেল, সেই চক্রের সঙ্গে তদন্ত কমিটির বড়জোর চা-চক্রে যোগ দেওয়াই যে সার হবে, তা–ও সবাই জানে।

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এই যৌথ চক্রচর্চার কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে আপাতত আর লোক নেবে না। এর আগে ২০০৯, ২০১৬ ও ২০১৮ সালেও একইভাবে চক্রের কারণে বন্ধ হয়েছিল দেশটির শ্রমবাজার। চারবার একই কারণে একই দেশের শ্রমবাজারের দরজা মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল—এটি যে লজ্জা-শরমের বিষয়, তা সরকার কতটুকু বুঝতে পেরেছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করতে পারি, একটা সময় পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে। তারপর মালয়েশিয়া আবার তার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য খুলে দেবে। আবার যথারীতি একটি চক্র গড়ে তোলা হবে।

তার জের ধরে পঞ্চমবারের মতো সেখানকার শ্রমবাজার বন্ধ হবে। তখন আবার ‘তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে; অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ মার্কা বক্তব্য আসবে। আবার আমরা তখন এই লেখাটির মতো একটি কলাম লিখব।

মাঝখান থেকে কলিম, বেলাল, তানভিররা ক্ষমতাধরদের নিষ্ঠুর প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে নিদারুণ অভিমানে আমাদের সবাইকে অভিশাপ দিতে দিতে কালের গলিত গর্ভে হারিয়ে যেতে থাকবেন।

কিন্তু তাঁদের সেই অভিমান ও অভিসম্পাত চক্র–চর্চাকারী গোষ্ঠীর হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে না।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]