ছাত্রলীগের ‘মানবিক’ চাঁদাবাজিতে ইজ্জত যাচ্ছে কার?

গত ১৩ অক্টোবর সেলফি পরিবহনের এই বাসগুলো আটক করে চাঁদা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়
ছবি : প্রথম আলো

গত শুক্রবার প্রথম আলোর অনলাইনে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ২০টি বাস আটকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দিল ছাত্রলীগ’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে সংবাদমাধ্যমকর্মী মেহেদি রাসেল খবরটির স্ক্রিনশট দিয়ে তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হতাশ হয়ে গেলাম! মাত্র ২০ হাজার।’ তাঁর এই পোস্টের নিচে বেশ কয়েকটি চোখা ও সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এসেছে, যা কৌতুক হিসেবে অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। কিন্তু একে একে সেগুলো জোড়া দিলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির একেবারে গোড়ার সমস্যা খোলাসা হয়ে পড়ে।

মন্তব্যকারীদের নাম উল্লেখ না করে কয়েকটি মন্তব্য দেখে নেওয়া যাক—‘পার বাস ১০০০ টাকা খুবই সস্তা রেট’, ‘মানবিক’, ‘২০,০০০ টাকার ট্যাক্স-ভ্যাট কে দেবে?’, মানবতা আজও আছে, ‘আমিও হতাশ’, ‘মাত্র! মান ইজ্জত আর রইলো না’, নগদে বিশ্বাসী সম্ভবত, বিকাশে নই’, ‘এরা সম্ভবত শায়েস্তা খাঁর অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মী, দ্রব্যমূল্যের বাজারে, মাত্র ২০ হাজার টাকা’।

যে ঘটনা থেকে বাস জিম্মি করে এই চাঁদা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, সেটি অবশ্যই গুরুতর অপরাধ। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র আবদুল্লাহ আল সাদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মীও। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার জন্য সেলফি পরিবহনের একটি বাসে উঠতে যান সাদ। এ সময় তাঁকে বাসে উঠতে না দিয়ে ধাক্কা দেন চালকের সহযোগী। তখন সাদ মাটিতে পড়ে গিয়ে আঘাত পান।

সাদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা দেওয়ার ঘটনাটি গুরুতর অপরাধ। বাংলাদেশের গণপরিবহনে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা অহরহ ঘটে। বাসের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে শিক্ষার্থী আর যাত্রীদের বচসা, হাতাহাতি প্রায় প্রতিনিয়ত ঘটে। যে পক্ষ শক্তিশালী থাকে, সেই পক্ষ অপর পক্ষকে ধরাশায়ী করে। নিষ্ঠুরতা অনেক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে বাসের চালক-সহকারীরা শিক্ষার্থী কিংবা যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন। এতে প্রাণ হারানোর মতো মর্মান্তিক পরিণতিও হয়। একটা সভ্য সমাজে এ ধরনের নৃশংসতা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যক্তির যে অধিকার ও মর্যাদা আছে, সেটাই কেউ মানতে চায় না। আইনের শাসন নিম্নগামী হওয়ায় ক্ষমতার বড়াই ঊর্ধ্বমুখী। ফলে কে কার চেয়ে ক্ষমতায় বড়, এই প্রদর্শনই চলে সবখানে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন কারা বাস আটক করে টাকা নিচ্ছেন, সেটা তিনি জানেন না। এভাবে না জানা কিংবা চুপ থাকা আর দুষ্কর্মের সহযোগী হওয়ার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যে বাস আটকে চাঁদাবাজি করছেন, আর তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল হচ্ছে—ইজ্জত বাঁচাতে অন্তত ফোঁস করাটা শিখুন।

সাদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার খবর ক্যাম্পাসে তাঁর সহকর্মীদের কাছে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কথা নয়। এর জেরে পরদিন শুক্রবার ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেন। একে একে সেলফি পরিবহনের ২০টি বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে সেগুলো আটকে রাখেন। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে লিটনসহ কয়েক নেতা। ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে বেলা দুইটার দিকে বাসগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনার জের কাটতে না কাটতে গতকাল শনিবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে লাব্বাইক পরিবহনের সাতটি বাস আটক করেন তাঁর সহপাঠীরা। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। হাফ ভাড়া নিয়ে বাসের সহকারীর সঙ্গে তাঁর বচসা হয়। একপর্যায়ে বাসের সহকারী ওই ছাত্রীকে হেনস্তা করে।

এ ঘটনায় তাঁর সহপাঠীরা যাত্রীদের নামিয়ে সাতটি বাস আটক করে চালক ও সহকারীদের মারধর করেন। পরে প্রতিটা বাসের চালকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেগুলো ছেড়ে দেন। প্রথম আলোর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি একটি বাসের সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, তাঁর কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে বাসটি ছেড়ে দেন। এবার বাসের চালক ও সহকারীদের যাঁরা মারধর করেছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে যাঁরা টাকা নিয়েছেন, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, না সাধারণ শিক্ষার্থী, সেটা জানা যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থী হলে দূষণ যে সর্বব্যাপী সংক্রামিত, তার দৃষ্টান্ত এ ঘটনা।

শুক্র ও শনিবার—বাস আটকের ঘটনা এ দুটি নয়। গত ২৫ জুলাই মাসে সাভার-আশুলিয়া রুটে চলাচলকারী ২৪টি লেগুনা ক্যাম্পাসে নিয়ে আটকে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কয়েক নেতা। লেগুনার চালক ও মালিকপক্ষ অভিযোগ করে বলেন, প্রতিদিন প্রতিটি লেগুনা থেকে ২৫ টাকা করে চাঁদা দেওয়া হতো ছাত্রলীগকে। এই রুটে প্রতিদিন ২০০টি লেগুনা চলাচল করে। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন এখন থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেওয়ার জন্য। চাঁদা আদায়ের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় লেগুনাগুলো আটকে রাখা হয়। ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা লেগুনাগুলো আটক করেন। তিন দিন পর ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে লেগুনার মালিকেরা আলোচনায় বসেন। পরে লেগুনাগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাস কিংবা লেগুনা আটকে রেখে চাঁদা নেওয়া যে একটা প্রবণতায় পরিণত হয়েছে, সেটা বলা চলে। পরিবহনশ্রমিকেরা যে দুর্ব্যবহার করেন, এটা সত্যি। গেটলক বা ওয়েবিল কিংবা অন্য কোনো সেবার নামে তাঁরা যে বাসভাড়া নিজেদের ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নেন, সেটাও সত্য। এই দুর্মূল্যের বাজারে অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই পুরো ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়।

আবার অনেক পরিবহনশ্রমিকদের মধ্যে এই প্রবণতাও আছে—শুক্রবার কেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়া হবে? এসব অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর প্রশ্নের মীমাংসা কখনো আমাদের সরকার কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ করে না। ফলে শিক্ষার্থী ও পরিবহনশ্রমিক প্রাচীন গ্রিসের সেই গ্লাডিয়েটর খেলার মতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। যে যাঁর সুযোগমতো ক্ষমতা জাহির করেন। তাতে অবশ্য সাময়িক ও তাৎক্ষণিকভাবে ফায়দা নিতে পারে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা করেছেন।

বাস ও লেগুনাগুলো আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব বলে একটা কিছু যে আছে, সেটা আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারি না। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেছেন, ‘কিছু হলেই বাস আটক করে, পরে টাকা নিয়ে বাসগুলো ছেড়ে দেবে, এতে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজ্জত নষ্ট হয়।’

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন কারা বাস আটক করে টাকা নিচ্ছেন, সেটা তিনি জানেন না। এভাবে না জানা কিংবা চুপ থাকা আর দুষ্কর্মের সহযোগী হওয়ার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যে বাস আটকে চাঁদাবাজি করছেন, আর তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল হচ্ছে—ইজ্জত বাঁচাতে অন্তত ফোঁস করাটা শিখুন।

ছাত্রলীগের নেতারা মানবিক ছাত্রলীগ গড়ে তোলার স্লোগান দেন। কিন্তু সেই স্লোগানের ইন্টারপ্রিটেশন যে ‘মানবিক’ চাঁদাবাজি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তার উত্তর কী?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী