গ্রেনেড হামলা রাজনীতিতে যে দেয়াল তৈরি করেছে

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

‘সারা দেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের’ প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। পরে অজ্ঞাত কারণে তড়িঘড়ি করে সমাবেশের স্থান সরিয়ে আনা হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। তিনি অনুষ্ঠানস্থলে বিকেল পাঁচটায় পৌঁছান। একটা ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর ঘোষণা দেন। তারপর তিনি ট্রাক থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। এমন সময় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।

এটা হলো সংবাদ। খুবই মর্মান্তিক, তবে এটি ঘটেছে। তবে এটাই প্রথম নয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সভা-মিছিলে হামলা, রাজনীতিবিদদের হত্যার চেষ্টা, ধরে বেঁধে এনে গুম করা কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার ইতিহাস এ দেশে নতুন নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা হয়ে আসছে ১৯৭২ সাল থেকেই। ক্রমে তার আকার ও প্রকার দুই-ই বেড়েছে। পুরোনো কাগজের পাতা ঘাঁটলে এসব জানা যায়।

আরও পড়ুন

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আগে এ রকম একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ৮–দলীয় জোটের সমাবেশ ছিল। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থলে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও আওয়ামী লীগের ৩০ জন নেতা-কর্মী নিহত হন বলে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়। ভিন্ন একটি সূত্রে জানা যায়, এতে ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩০০ জন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই পুলিশ ও বিডিআর গুলি করেছিল।

চট্টগ্রামের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিল। আদালতের রায়ে পাঁচজন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির আদেশ হয়। তাঁরা হলেন কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আবদুল্লাহ, মমতাজ উদ্দিন ও প্যাট্রোল ইন্সপেক্টর জে সি মণ্ডল। আদালতের রায়ের ওপর মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু এ রকম একটি ভয়াবহ ঘটনা কনস্টেবল-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কতিপয় সদস্য ঘটিয়ে ফেলবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা সমীকরণ বরাবরই ছিল। তা সত্ত্বেও ফাঁসিতে ঝুলতে হলো নিচু স্তরের পাঁচ পুলিশ সদস্যকে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনায় কোনো কনস্টেবলের কথা উঠে আসেনি। সেখানে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে ওপরতলার দিকে। এ নিয়ে পরে মামলা হয়েছে। বিচারিক আদালতে উচ্চপদস্থ সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তাসহ অনেকেরই মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। মামলাটি এখন আপিল পর্যায়ে উচ্চ আদালতে আছে। ইতিমধ্যে তিনজনের ফাঁসি হয়ে গেছে অন্য মামলার বিচারের রায়ে।

গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। দুই দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা অতিক্রম করা কঠিন, যদি না তারা একটি সাধারণ শত্রুর মুখোমুখি হয়, যেমনটি তারা কিছুদিনের জন্য পেয়েছিল আশির দশকে। তবে এই বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করাই তো দূরদর্শী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের কাজ।

২৪ জানুয়ারির ঘটনা অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু ২১ আগস্ট এখনো সংবাদ শিরোনাম হয়। কারণ, এটির প্রাসঙ্গিকতা রয়ে গেছে। এ ঘটনায় যে দুই পক্ষ জড়িয়ে আছে, রাজনীতিতে তারা পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ। এই দ্বৈরথ যত দিন থাকবে, তত দিন ২১ আগস্ট নিয়ে আলোচনা হবে, রাজনীতিও হবে।

২১ আগস্ট নিয়ে আদালতের রায়ের বাইরে রাজনীতির দুই পক্ষের আলাদা বয়ান আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই ঘটনার পর ২৬ আগস্ট তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হামলার পেছনে গোপন সংগঠন, ধর্মীয় উগ্রবাদী, অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক শক্তির সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে আসামের উলফা নামের সশস্ত্র সংগঠনটির তৎপরতার কথাও শোনা গেছে। আমাদের জানা আছে, একটা জনসভায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং পরে বিরোধী দলের নেতা রাজীব গান্ধী বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন। তদন্ত ও বিচারে শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন এলটিটিইর সরাসরি ভূমিকার কথা উঠে আসে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আক্রমণকারীর মোটিভ কী? প্রতিহিংসা, নাকি রাজনীতির চরিত্র এমনই।

২১ আগস্টের ঘটনার সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। ওই সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এর মানে এই নয় যে তিনি এ রকম একটি হামলায় মদদ দিয়েছিলেন বা এ ব্যাপারে জানতেন। কিন্তু এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করে যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখানো ও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, সেটি তিনি করেননি। এ নিয়ে শেখ হাসিনার ক্ষোভ আছে। তিনি সম্প্রতি একটি দলীয় আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘আমরা যখন জাতীয় সংসদে গিয়ে বিষয়টি তুলতে চেষ্টা করলাম, তখন কিছুতেই এ ব্যাপারে কথা বলতে দেবে না। শোকপ্রস্তাব দিতে চাইলাম, সেটা প্রত্যাখ্যান করা হলো, নিল না। আমরা যারা কথা বলতে চেয়েছি, তাদের কোনো মাইক দেওয়া হলো না। খালেদা জিয়া নিজেই দাঁড়িয়ে বললেন, ওনাকে আবার কে মারবে। উনি তো ভ্যানিটি ব্যাগে করে নিজেই গ্রেনেড নিয়ে সেখানে গেছেন এবং নিজেই গ্রেনেড মেরেছেন। এটা খালেদা জিয়ার নিজের ভাষ্য।’

আরও পড়ুন

ঘটনার পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করতে গেছে, ঠিক সে সময় পুলিশ উল্টো টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ও তাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে পুলিশ যখন উল্টো টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তার করতে শুরু করল, তখন বুঝতে পারা যায় যে এ ঘটনা তাদের মদদে হয়েছে।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ২১ আগস্টের হামলা-মামলা নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি করছে। ওই ঘটনা ছিল গভীর নীলনকশার অংশ। যে নীলনকশার সঙ্গে ক্ষমতাসীনেরা জড়িত কি না, তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’ মুশকিল হলো, এই নীলনকশা উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা ওই সময় তাঁর দলের সরকার ঠিকমতো করেনি। করলে তাঁদের ওপর দায় পড়ত না।

বাংলাদেশের রাজনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার মতো। এক. শুরু থেকেই এখানে রাজনীতি হয়েছে কর্তৃত্ববাদী। দুই. কোনো দলই ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য যত কৌশল নেওয়া দরকার, তা নেয়। এই ইচ্ছার প্রকাশ হয় অমার্জিতভাবে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো নির্মূলের রাজনীতি। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা নিয়েছে প্রতিপক্ষকে দৃশ্যপট থেকে মুছে দেওয়ার এক নির্মম আয়োজন।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, তাঁদের দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার জন্যই সেদিনের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরে। ১৯৭৫ আর ২০০৪ সালকে তাঁরা একসূত্রে বাঁধা বলে মনে করেন।

গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। দুই দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা অতিক্রম করা কঠিন, যদি না তারা একটি সাধারণ শত্রুর মুখোমুখি হয়, যেমনটি তারা কিছুদিনের জন্য পেয়েছিল আশির দশকে। তবে এই বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করাই তো দূরদর্শী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের কাজ।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক