বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ যেন অন্ধ কসাইয়ের হাতের ছুরি, যেখানে যায়, সেখানেই নির্বিচার কাটে—হোক তা বন, পাহাড় কিংবা হাতির চলার পথ (করিডর)। উন্নয়নের নামে এমন ‘পরিবেশবিনাশী’ প্রকল্পের অন্যতম উদাহরণ চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ।
লোহাগাড়ার চুনতি, ফাঁসিয়াখালী, মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনের ২৭ কিলোমিটার এলাকা চিরে পাতা হয়েছে এটি। কাটা পড়েছে প্রায় আড়াই লাখ গাছ। একের পর এক পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করা হয়েছে। এ রেলপথ শুধু গাছ বা পাহাড়ই কাটেনি, হাতির চলাচলের পথও ‘কেটে’ দিয়েছে। রেলপথটি যেন ধুঁকতে থাকা প্রকৃতির ওপর আরেক দফায় দুরমুশপেটা।
অগ্রাধিকার প্রকল্প বলে কথা, তাই পদে পদে পরিবেশের গলা চিপে ধরা হলেও বন বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তর বাধা দেয়নি। উল্টো বনের ২০৭ একর এলাকা এক ফরমাশে ‘সংরক্ষিত’ থেকে হয়ে গেছে ‘উন্মুক্ত’।
অবশ্য পরিবেশ সংরক্ষণে চারটি শর্ত দিয়েছিল বন বিভাগ। বলাই বাহুল্য, সেসব শর্ত পুরোপুরি মানা হয়নি। ফলে বিপণ্নপ্রায় এশিয়ান হাতি চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রাণীগুলোর জীবনও পড়েছে ঝুঁকিতে।
গত বছরের অক্টোবরে একটি বাচ্চা হাতি ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়। জুলাইয়ের ২২ তারিখ রাতেও চুনতির বনে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যেতে বসেছিল একটি হাতির। চালক দেখতে পেয়ে ট্রেন থামিয়েছিলেন বলে প্রাণীটি রক্ষা পেয়েছে।
তবে রেলপথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা হাতিটিকে সরাতে বারবার ট্রেনের হুইসেল বাজানো হয়। এতে ‘বিরক্ত’ হয়ে সে একটি বগিতে ধাক্কা দিতে থাকে। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য শেষতক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেনি।
কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, তা আগেই হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) হাতির যে ১২টি করিডর চিহ্নিত করেছে। সরকার সেগুলোর সুরক্ষা দেওয়ার কথা কবুল করেছে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, করিডরে ট্রেন চলছে আর হাতি লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে!
শুধু ট্রেনের ধাক্কায় নয়, কৃষকের পেতে রাখা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে, বনদস্যুদের আক্রমণে, ঝিরির কাদায় আটকে, পাহাড় থেকে পড়ে, খাদ্যে বিষক্রিয়ায় হাতি মারা পড়ছে।
গত এক দশকে শুধু বাঁশখালী অঞ্চলেই ১৭টি হাতি হত্যার শিকার। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে। হাতি মারার জন্য কেউ শাস্তি পেয়েছে—দেশে এমন ‘রূপকথা’ এখনো লেখা হয়নি।
কিন্তু বাস্তবতা এটাই, করিডর কমে যাওয়ায় হাতি লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে মানুষ ও বন্য এই প্রাণীর মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও বাড়ছে। হাতির আক্রমণে কৃষকের মৃত্যুর ঘটনাও আমরা দেখেছি। প্রকৃতির প্রতিশোধই কি তবে ‘শেষ ভরসা’?
২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশে বন্য হাতির সংখ্যা মাত্র ২৬৮। এর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় আছে ৪০টির মতো। এত কমসংখ্যক প্রাণীর টিকে থাকার জায়গাটুকুও কি ‘দখল’ না করলে চলত না?
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের আরেকটা ‘চমৎকার’ দিক হলো পাহাড় কাটার ফলে বর্ষায় ধস নামে। গত বছর দুই দুইবার রেলপথে ধসে পড়া মাটি ট্রেন চলাচল থামিয়ে দিয়েছিল। একে কি উন্নয়নের ‘অগ্রযাত্রা’ থামিয়ে দেওয়ার ‘প্রাকৃতিক ষড়যন্ত্র’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে!
ট্রেনচালকের বিচক্ষণতায় ২২ জুলাই রাতে হাতিটি তো রক্ষা পেল, কিন্তু ট্রেনে বগিতে ‘ধাক্কা’ দিয়ে প্রাণীটি আসলে কী বার্তা দিল? এ ধাক্কা কি আমাদের বিবেকের দরজায় করাঘাত নয়? হাতিটি যেন এ কথাই এলান করেছে, ‘তোমরা আমাদের “বাড়ি” দখল করেছ, এবার আমরাও তোমাদের পথ আটকে দাঁড়াব।’
অনেকেরই মনে থাকার কথা, সাতকানিয়া ও বড় হাতিয়া এলাকায় পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে ‘হ্রদ’ বানানো হয়েছিল। ফলে করিডর তলিয়ে যায়। তিন বছর ধরে হাতির দল চলতে-ফিরতে পারেনি ওই এলাকায়। এভাবেই প্রকৃতির ওপর একের পর এক ‘দখল’ নিচ্ছি আমরা, সেই প্রকৃতি যার ওপর নির্ভর করে আমাদের টিকে থাকাও।
পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বহু সুপারিশ করেছেন—করিডর উন্মুক্ত রাখতে হবে, বিদ্যুতের ফাঁদ সরাতে হবে, হাতির খাদ্য-পানির ব্যবস্থা করতে হবে, জনসচেতনতা গড়তে হবে, নতুন প্রকল্প নিতে হবে...তালিকা লম্বা, কিন্তু দৃশ্যমান শুধু ‘উন্নয়ন’।
প্রথম আলোয় ‘ট্রেনের বগিতে হাতির ধাক্কা’ প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছে ২৪ জুলাই। একই দিন ‘যে বনে একটি মাত্র গাছ’ শিরোনামের আরেকটি প্রতিবেদন আছে পত্রিকাটিতে। উপমহাদেশের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের একটি ছিল ‘চকরিয়া সুন্দরবন’। আয়তন ছিল ৩০ বর্গকিলোমিটারের বেশি। সেখানে এখন মাত্র একটি গাছ দাঁড়িয়ে।
এই একটা গাছ, এই একটি হাতি যেন এই প্রশ্নই ছুড়ে দিচ্ছে—আর কতটা ‘খালি’ করলে বুঝতে পারব আমরা কী হারিয়েছি?
সময়ের চাকায় আমাদের জীবনের গতি বাঁধা। উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেটি পরিবেশ বিনষ্ট করে নয়, বাস্তুতন্ত্রকে লন্ডভন্ড করে নয়, প্রাণ-প্রকৃতির ভবিষ্যৎকে খাদে ফেলে নয়। না হলে, ‘ট্রেন’ চলবে ঠিকই, কিন্তু ‘গন্তব্যে’ পৌঁছাবে না…।
হাসান ইমাম: সাংবাদিক
hello. hasanimam@gmail. com
