ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট জামিন পেয়ে কারামুক্ত (পড়ুন হাসপাতাল) হয়েছেন। যে মানুষটিকে কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘ভীষণ অসুস্থ হয়ে’ হাসপাতালে থাকতে হচ্ছিল, তিনি মুক্ত হয়ে রীতিমতো ঢাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারামুক্ত হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাওয়ার সময় অনেক মোটরসাইকেলসহ তাঁর বিরাট ‘শোভাযাত্রা’-এর ফলে ছুটির দিনেও ঢাকার বড় একটি এলাকায় বেশ যানজট লেগে যায়।

এই দফা জামিনের আগেও একবার জামিন পেয়েছিলেন সম্রাট। ১১ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় তিন শর্তে জামিন পান তিনি। কিন্তু দুদক হাইকোর্টে গেলে হাইকোর্ট সম্রাটের জামিন বাতিল করে দেন। এতে সম্রাট আর বেরোতে পারেননি।

এ দফা জামিনের পর সম্রাট বেরিয়েছেন, তবে এবারও দুদক উচ্চ আদালতে গেছে জামিন বাতিল করার জন্য। এর ফল কী হবে জানি না, কিন্তু সম্রাটের এখন জামিনে বেরিয়ে আসা, এমনকি আগেরবার জামিন মঞ্জুরের খবরে অনেকের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছিলাম। ফেসবুকে নানা রকম সিরিয়াস মন্তব্যে এবং ট্রলের মাধ্যমে বিষয়টির প্রতিবাদ করছেন অনেকেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সম্রাট তো তাঁর সব মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যাননি, জামিন পেয়েছেন মাত্র, তবুও মানুষ এত ক্ষুব্ধ কেন?

ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দর্শনে বিখ্যাত ব্রিটিশ আইনজ্ঞ উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোন নির্দেশিত ব্ল্যাকস্টোনস ফরমুলেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এতে বলা হয় একজন নিরপরাধ মানুষের শাস্তি পাওয়ার চেয়ে দশজন অপরাধী মুক্ত হয়ে যাওয়া ভালো। আমরা নিশ্চয়ই বুঝি এই বক্তব্যের গুরুত্ব।

একজন মানুষকে আইনের দৃষ্টিতে তখনই চূড়ান্তভাবে অপরাধী বলা হয়, যখন তিনি নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর যদি উচ্চ আদালতে যান এবং সেখানেও তাঁর সাজা বহাল থাকে। বহু ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের সমাজের ভয়ংকর অপরাধীদের চিনি, তাদের অপরাধ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানি। আমরা নিজেরাই অনেকে সেসব অপরাধের সাক্ষীও। তাই বিচারপ্রক্রিয়ার এতগুলো ধাপ আমাদের অনেককে হয়তো ক্ষুব্ধ করে। আমরা অনেকেই ভাবি এত নিশ্চিতভাবে জানা একটি বিষয়ও কেন এত দীর্ঘ আইনিপ্রক্রিয়া লাগবে।

তেমনি চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা ও মাস্তান-সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ যে সম্রাটের বিরুদ্ধে তিনি আসলে মূল লোক বা ‘মালিক’ নন। এর ওপরে আছেন আরও অনেকে। সম্রাটকে আমরা আরও অনেক কাল জেলে দেখতে চেয়েছিলাম, কারণ আমরা জানি, শুধু সম্রাট নন, তাঁর মতো আরও অনেককে যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা নেই আমাদের। তাঁরা থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সম্রাটকে ভুগতে দেখে আমাদের সেই আসল ক্ষোভ প্রশমিত হয় কিছুটা হলেও।

আমাদের এই মানসিকতার প্রভাব আমরা দেখি যখন আমরা হাতেনাতে কোনো চোর, ডাকাত কিংবা ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলতে পারি। ভয়ংকরভাবে পিটিয়ে জখম তো করিই আমরা, অনেক সময় মেরেও ফেলি। ঠিক তেমনি কোনো চিহ্নিত অপরাধীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ কিংবা এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা করে ফেলে, তাহলে আমরা অনেকেই সেটাকেও সমর্থন করি।

কিন্তু একটা আধুনিক রাষ্ট্র বলতে আমরা বুঝি সেটা এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে যা ভয়ংকরতম অপরাধে অভিযুক্ত মানুষকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দেবে। কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আমাদের হাতে থাকা প্রমাণ, এমনকি সমাজে প্রচলিত ধারণা বিচারিক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে পারে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই কাউকে অপরাধী হিসাবে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে না। এই বিচারিক পদ্ধতিকে যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে সব ধাপ পেরিয়ে যেকোনো মানুষ অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অপরাধী হিসাবে নিশ্চিত হওয়ার আগে জেলে থাকা তার ওপর আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় বলেই মনে হওয়ার কথা।

ফৌজদারি মামলাগুলোকে আবার জামিনযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। খুব জরুরি কোনো বিষয় না থাকলে জামিনযোগ্য মামলাগুলোতে জামিন দেওয়াই রীতি। এমনকি জামিন অযোগ্য যেসব মামলা, সেসব মামলার ক্ষেত্রেও বিচারক চাইলে জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। ফৌজদারি মামলায় জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারক এটা বিবেচনায় নেন অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্ত থাকলে মামলার বাদীর প্রতি কোন হুমকি তৈরি করবেন কি না, তিনি পালিয়ে যাবেন কি না কিংবা মামলার তদন্ত প্রভাবিত করবেন কি না ইত্যাদি। এমন সম্ভাবনা না থাকলে সাধারণত জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তির লিঙ্গ, বয়স, সামাজিক অবস্থান, শারীরিক অবস্থা এসব বিষয়ও জামিনের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে।

সাধারণভাবে আমাদের চাওয়া উচিত কোনো মানুষ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত যেন জেলে না থাকেন। একটি অবস্থা কল্পনা করা যাক। কোনো একটি ফৌজদারি মামলায় একজন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন এবং জামিন পাননি বা বেশ পরে পেয়েছেন। এই মামলায় তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তাঁকে দেওয়া কারাদণ্ড তাঁর মামলা চলাকালে কারাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু কেউ যদি বিচারিক প্রক্রিয়ায় নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে সেই মানুষটি যত দিন জেলে ছিলেন, সে সময়ের ক্ষতি তাঁর জীবনে কি কোনোভাবে পূরণ হয়? আমরা এমন একটি দেশে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, যেখানে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সরকারের দিক থেকে বিরোধীদের ওপর নানা নিপীড়নমূলক ভুয়া মামলার ভীষণ ছড়াছড়ি।

আমরা যদি একটি আধুনিক, উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা ভাবি, তাহলে আমাদের সবার উচিত হবে সমাজের সবচেয়ে নিন্দিত ভয়ংকর মানুষটাও যেন ন্যায়বিচার পান। তিনিও যেন রাষ্ট্রের অবিচারের শিকার না হন। আমাদের চাওয়ার কথা বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ার আগে কেউ যেন কারাভোগ না করেন।

এই শহরে চোখ-কান খোলা রাখা মানুষমাত্রই সম্রাট সম্পর্কে জানেন দীর্ঘদিন থেকেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটির চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মূল নেতৃত্ব দিতেন সম্রাট, এটা একরকম জানাই ছিল। এমনকি গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস আগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে চাঁদা চেয়ে পত্রিকায় খবরও হয়েছিলেন তিনি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সম্রাটের কোনো সমস্যা না হলেও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে চাঁদা চাওয়ার কারণে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিরাগভাজন হন তিনি। এই পরিস্থিতিতে সম্রাট বিদেশে চলে যান। সেখান থেকে সরকারের ‘উঁচু মহল’ ম্যানেজ করে দেশে ফিরে এসে আবার তাঁর কাজ করে যেতে থাকেন।

চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা ও মাস্তান-সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ যে সম্রাটের বিরুদ্ধে তিনি আসলে মূল লোক বা ‘মালিক’ নন
ছবি : প্রথম আলো

সম্রাট কী করছেন, সেটা সরকারের উচ্চ পর্যায়েও জানা ছিল। সেটার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই। তখন সম্রাটকে নিয়ে বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্টে কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘এক বছর আগেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সম্রাটের ব্যাপারে সজাগ থাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবৎই এটি ওয়াচ করছিলেন। আমাদের বৈঠকে উনি সুপরিকল্পিতভাবে বিষয়টি নেতাদের জানাতে চেয়েছিলেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। সেই বৈঠকে তিনি কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছিলেন।’ (বিবিসি বাংলা, ৬ অক্টোবর, ২০১৯)

সম্রাট যে দল করেন, সেই দলের পক্ষ থেকে এই মনোভাব জানার পরও তো আমাদের সম্রাটের জন্য ন্যায়বিচার চাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে সম্রাটের জামিন নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা আমাদের দেশের ক্ষমতা এবং বিচারব্যবস্থার এক ভয়ংকর ক্ষতকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। জনগণের মনে এই ধারণা প্রবল এবং এর বাস্তবতাও রয়েছে যে, কেউ যদি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হন, তাঁর পক্ষে এই বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া খুব সম্ভব।

সম্রাটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে সেটা। তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় গ্রেপ্তার আরেক আলোচিত ব্যক্তি জি কে শামীম আর সম্রাট কোনো রকম অসুস্থতা ছাড়াই মাসের পর মাস হাসপাতালে আয়েশি জীবন যাপন করতে পেরেছেন। এমনকি মানুষ দেখল ‘ভীষণ অসুস্থ’ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি একজন মানুষ জামিনে মুক্তি পেয়েই ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

শুধু সেটাই নয়, প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকেই জানা যায়, সম্রাটের বিরুদ্ধে সে সময়ে যে চারটি মামলা হয়েছিল, তার একটির (মানি লন্ডারিং) তদন্তই শেষ হয়নি এখনো। তিনটির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, কিন্তু চার্জ গঠন হয়নি। বিচারকার্য শুরু হওয়া এখনো অনেক দূরের কথা। এ দেশে বসবাস করে আমাদের মনে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে সম্রাটদের মতো লোকজনকে শেষ পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া যায় না। তাই যে কদিন তিনি জেলে আছেন, সেটাকে একধরনের শাস্তি হিসাবে দেখে আমরা পরিতৃপ্তি লাভ করতে চেয়েছি। জামিন পেয়ে সম্রাটের বেরিয়ে আসা এ জন্যই ক্ষুব্ধ করেছে আমাদের।

আরও পড়ুন

বিচার শুরু না হওয়া উদ্বেগের

তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় সম্রাটকে দেশের শীর্ষ অপরাধী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা ছিল সরকারের পক্ষে থেকে, কিন্তু সম্রাটকে একজন ‘রাখালবালক’ এর চেয়ে বেশি কিছু ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই। একজন রাখালবালক যখন গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায়, খাওয়ায়, আবার নিয়ে ফিরে আসে, এটা দেখে তথ্য না জানা মানুষের ভুলক্রমে মনে হতেও পারে, ওই রাখালবালকই বুঝি গরুর পালের মালিক। জানাশোনা মানুষ জানে, রাখালবালক একটা চাকরি করছে, গরুর পালকে আগলে রাখা, পরিচালনা করা তার দায়িত্ব, যার বিনিময়ে সে টাকা পাবে, সে এর মালিক নয়।

তেমনি চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা ও মাস্তান-সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ যে সম্রাটের বিরুদ্ধে তিনি আসলে মূল লোক বা ‘মালিক’ নন। এর ওপরে আছেন আরও অনেকে। সম্রাটকে আমরা আরও অনেক কাল জেলে দেখতে চেয়েছিলাম, কারণ আমরা জানি, শুধু সম্রাট নন, তাঁর মতো আরও অনেককে যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা নেই আমাদের। তাঁরা থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সম্রাটকে ভুগতে দেখে আমাদের সেই আসল ক্ষোভ প্রশমিত হয় কিছুটা হলেও। ঠিক যেমন পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের জন্য দায়ী অতি শক্তিমান মূল হোতাদের কিছু করতে না পারার ঝাল আমরা বাসচালক আর ভাড়া নিতে আসা কর্মীটির ওপরে ঝাড়ি!

  • ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক