৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। যাঁরা এ নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁরাও এই ফলাফল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। অনেকেই বলছেন, নতুন ‘সার্কুলার পদ্ধতি’তে যেভাবে তাড়াহুড়া করে খাতা দেখা হয়েছে, তাতে খাতার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এ কারণে এবারের লিখিত পরীক্ষায় খুবই কমসংখ্যক প্রার্থী পাস করেছেন। ক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা বলছেন, এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর ফেল করার ব্যাপারটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। অতীতের পরিসংখ্যানও তা–ই বলে।
৪০তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার জন্য ২০ হাজারের মতো প্রার্থীকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার উত্তীর্ণ হন। ৪১তম বিসিএসে ২১ হাজারের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার, ৪৩তম বিসিএসে ১৫ হাজারের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার, ৪৪তম বিসিএসে ১৬ হাজারের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ও ৪৫তম বিসিএসে ১৩ হাজারের মধ্যে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গত পাঁচবারের লিখিত পরীক্ষায় পাসের হার ৫৫ থেকে ৭৫ শতাংশের মধ্যে থেকেছে, অথচ ৪৬তম লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ১৯ শতাংশের নিচে!
আগে একটি খাতা দুজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করতেন। দুজন পরীক্ষকের দেওয়া নম্বর গড় করে একজন প্রার্থীর চূড়ান্ত নম্বর নির্ধারণ করা হতো। তাঁদের দেওয়া নম্বরের ব্যবধান ২০ শতাংশের বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে একই খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হতো। প্রতিবার একজন নিরীক্ষক পর্যবেক্ষণ করে দেখতেন, নম্বর প্রদানে পরীক্ষকের কোনো ভুলত্রুটি ঘটেছে কি না। ভুল হলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষককে পিএসসিতে গিয়ে নিজ হাতে সংশোধন করে দিয়ে আসতে হতো। এই পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগত, কিন্তু প্রাপ্ত নম্বর ও মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে প্রার্থীদের আপত্তি ছিল না।
দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতির বিপরীতে পিএসসি সার্কুলার পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নের কাজ শুরু করেছে। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষকেরা সরাসরি পিএসসিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা বসে খাতা দেখার কাজ করেন। এভাবে পরপর পাঁচ থেকে সাত দিন হাজার হাজার খাতা মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। দ্রুতগতিতে বিপুলসংখ্যক খাতা দেখার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে ভুলভ্রান্তি বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া সপ্তাহজুড়ে সারা দিন বসিয়ে রেখে খাতা দেখার কাজ সম্পন্ন করা হলে ভবিষ্যতে ভালো পরীক্ষকদের পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়বে।
সার্কুলার পদ্ধতির আরেক সমস্যা হলো একজন পরীক্ষকের মূল্যায়নই এখন চূড়ান্ত ধরা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় যদিও একটি খাতা কয়েকজন পরীক্ষকের হাতে যায়, কিন্তু তাঁরা নির্দিষ্ট প্রশ্নের জন্যই নম্বর দিয়ে থাকেন। যেমন প্রশ্নের প্রথম উত্তরটি যিনি মূল্যায়ন করেন, তিনি প্রতিটি খাতারই প্রথম উত্তর দেখেন। এরপর দ্বিতীয় উত্তর দেখার জন্য খাতাটি আরেকজন পরীক্ষকের কাছে দেওয়া হয়। এভাবে প্রবাহ বা সার্কুলেশন চলতে থাকে বলে এর নাম হয়েছে সার্কুলার পদ্ধতি। প্রক্রিয়াটিকে অবশ্যই ভালো বলা যেত, যদি সীমিতসংখ্যক খাতা দেখার জন্য এই উপায় অবলম্বন করা হতো।
২০ থেকে ২২ হাজার খাতা দেখার জন্য এই প্রক্রিয়া মোটেই কার্যকর বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, প্রশ্নের প্রথম উত্তরটি মাত্র একজন পরীক্ষকের পক্ষে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। এই উত্তর দেখার জন্য তাঁর মতো আরও ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। তাঁদের মূল্যায়ন যেহেতু কোনোভাবেই একরকম হবে না, সেহেতু শিক্ষকভেদে প্রার্থীদের নম্বরের ব্যবধানও তৈরি হবে। এদিক থেকে দুজন পরীক্ষকের নম্বর গড় করার আগের পদ্ধতি ভালো ছিল। নতুন পদ্ধতিতে কাজে গতি আসতে পারে, কিন্তু এভাবে প্রকৃত মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করা কঠিন। তা ছাড়া বিসিএস পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন নিয়ে কোনো আবেদনকারীর আপত্তি থাকলে তা চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ নেই। তার মানে ক্ষুব্ধ হওয়া বা বঞ্চিত মনে করা কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রতিকার লাভ করাও সম্ভব নয়।
পিএসসি অভিযোগ করে থাকে, আগের পদ্ধতিতে পরীক্ষকেরা লিখিত পরীক্ষার খাতা নিয়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখতেন। এ কারণে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করতে দেরি হতো। কিন্তু এ সময়ক্ষেপণের সমাধানও তো পিএসসি করেছিল। প্রতি ১০০ খাতা মূল্যায়ন করতে পিএসসি একজন পরীক্ষককে ১৫ দিন সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেটি মানতে বাধ্য করার দরুন ফল প্রকাশেও প্রত্যাশিত গতি এসেছিল। প্রয়োজনে ১৫ দিন সময় কমিয়ে ১২ দিন করা যায়। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে পাঁচ থেকে সাত দিন একটানা বসিয়ে এক-দেড় হাজার খাতা মূল্যায়ন করতে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্নের মানবণ্টন নিয়ে চিন্তা করলেও খাতা মূল্যায়নের সময় কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন বাংলা ০০১ ও ০০২ নামে দুটি বিষয় কোডের পরীক্ষা হয়ে থাকে। ০০১ কোডের মোট নম্বর ১০০, সময় ৩ ঘণ্টা। এই একই সিলেবাস ও প্রশ্নপদ্ধতির ১০০ নম্বরের সঙ্গে আরও ১০০ নম্বরের প্রশ্ন যোগ করে ০০২ কোডের পরীক্ষা নেওয়া হয়। ০০২ কোডের পরীক্ষার প্রথম ১০০ নম্বর ০০১ কোডের পরীক্ষার হুবহু অনুরূপ। প্রশ্নের এই অংশে নতুন কিছুই থাকে না, এমনকি ব্যতিক্রম কিছু যাচাইও করা হয় না। সে ক্ষেত্রে ০০২ কোডের প্রশ্নপত্র ২০০ নম্বরের না রেখে পৃথক সিলেবাসের অংশটুকু নিয়ে ১০০ নম্বরের করা যায়। তাতে খাতা দেখার ক্ষেত্রেও অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ সময় কমে আসবে।
পিএসসি নতুন করে সিলেবাস ও মানবণ্টন নিয়ে কাজ করছে। তা ছাড়া এক বছরে একটি বিসিএস সম্পন্ন করার পরিকল্পনাও নিয়েছে। এগুলো ভালো উদ্যোগ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মূল্যায়নের কোনো ধাপে যেন পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীরা বাদ না পড়েন।
• তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
