গত ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ সংবিধানের ২৭তম সংশোধন অনুমোদন করেছে। পাঁচ দিনের উত্তপ্ত বিতর্ক, বিরোধী দলের বিরোধিতা এবং শেষ মুহূর্তের কিছু সংশোধনীর পর এটি নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষেই পাস হয়।
এর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা পৃথক্করণ (যার মাধ্যমে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার অধীন সশস্ত্র বাহিনী দায়বদ্ধ ছিল) রহিত হলো। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের অধীন বিভাগে পরিণত করা হলো।
এ ঘটনাকে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিতভাবে বললে, সাংবিধানিক এই সংশোধনের মাধ্যমে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো সূচিত হলো—(ক) একটি ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হবে।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট বা সর্বোচ্চ আদালত একটি অ্যাপিলেট কোর্ট বা আপিল আদালতের আকার ধারণ করবে, যা শুধু দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়াদি বিচারের জন্য কাজ করবে। এর ফলে সংবিধানসংক্রান্ত, জনস্বার্থ এবং মানবাধিকার–সম্পর্কিত বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন থাকবে না। (খ) এ সংশোধনীর আওতায় ফিল্ড মার্শাল হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তি সব ধরনের গ্রেপ্তার, অপরাধ ও সিভিল দায় থেকে সারা জীবনের জন্য মুক্তি পাবেন। তিনি সারা জীবন ফিল্ড মার্শাল পদবিসংক্রান্ত দায়িত্ব ও সুবিধা পাবেন।
পাকিস্তানের এই সংবিধান সংশোধন বুঝিয়ে দেয়, একটি উচ্চকক্ষ ক্ষমতার ভারসাম্য বা কোনো ব্যক্তির একক ক্ষমতা কুক্ষিগত করাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একক কার্যকর সংসদীয় কাঠামো নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতার কাঠামোকে দায়বদ্ধতায় আনার উপাদানগুলো নিয়ে কাজ না করে শুধু উচ্চকক্ষ সৃষ্টি কখনই ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। এ ঘটনা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার আছে।
গত ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় গণভোট–সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। অধ্যাদেশ মোতাবেক আগামী জাতীয় সংসদে নির্বাচনের ভোট গ্রহণকালে গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকরের গণরায় প্রতিপালনের চাপ থাকবে পরবর্তী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের কাছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় একাধিক বিষয়কে একসঙ্গে করে গণভোট নেওয়া হচ্ছে, তা ত্রুটিপূর্ণ।
এর চেয়েও বড় বিষয় হলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে—বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চকক্ষ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা প্রয়োজন। সেটা বর্তমানের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং শক্তিশালী করে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্ভব।
২০২৪-এর আন্দোলন–পরবর্তী সময় দাবি উঠেছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও দলীয় প্রধানের ক্ষমতা সীমিতকরণ এবং সংবিধান সংশোধনের একচ্ছত্র ক্ষমতা ক্ষমতাসীন দল/দলীয় প্রধানের হাতে কুক্ষিগত না রাখার জন্য উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, কারণ, এটি ভারসাম্য সৃষ্টি করবে। সিপিডি মনে করে বর্তমান বাস্তবতায় উচ্চকক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল/দলীয় প্রধান বা বিশেষ গোষ্ঠীর ক্ষমতা সীমিতকরণে খুব কমই ভূমিকা রাখতে পারবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তার সদস্যসংখ্যা হবে ১০০। নিম্নকক্ষের সংসদীয় আসনের ভোটের আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে। বিগত নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মূল চারটি দলই অধিকাংশ আসন ও ভোট পেয়েছে। এ প্রবণতা দেখা গেছে, অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে (যেমন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে)।
এবারের নির্বাচনে বড় দলগুলোর বিপরীতে অন্য দলগুলোর ম্রিয়মাণ উপস্থিতি উচ্চকক্ষে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের খুব কম সদস্যই নিশ্চিত করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে। বরং প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের কাঠামো নিম্নকক্ষের একটি প্রতিরূপ হতে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রভাব-দাপট নিম্নকক্ষের মতো উচ্চকক্ষেও প্রতিফলিত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
প্রশ্ন হলো উচ্চকক্ষে কারা প্রতিনিধি হয়ে আসছেন। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যক্তিদের থেকে ৪০ শতাংশ এবং বাকি ৬০ শতাংশ তারা পছন্দ করবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধি থেকে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও নারী প্রতিনিধি যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকছে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উচ্চকক্ষে যাঁরা আসবেন, তাঁরা সবাই রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনৈতিক দলের অনুগ্রাহী অরাজনৈতিক ব্যক্তি, সিভিল সোসাইটির লোক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ইত্যাদি।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, যাঁরা উচ্চকক্ষে আসবেন, তাঁরা বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, তাঁরা সরাসরি নির্বাচিত নন। যত দূর জানা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগ্রহভাজন, যাঁদের অন্য কোথাও দায়িত্ব দেওয়া যাচ্ছে না, বয়স্ক রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, একাডেমিয়া ও সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিরা সদস্য হবেন।
উচ্চকক্ষের এ সদস্যরা জাতীয় স্বার্থে কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হওয়ার কারণে স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে তাঁদের খুব কমই দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাবে। বিদেশি গোষ্ঠীর প্রভাবও উপেক্ষা করা উচ্চকক্ষের সদস্যদের জন্য কষ্টকর হবে। উচ্চকক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপদেষ্টামূলক দায়িত্ব পালন করবে, যেখানে নিম্নকক্ষের উত্থাপিত বিলের ওপর উচ্চকক্ষ তার মতামত দিতে পারবে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের বিল অনুমোদনের ক্ষমতা থাকবে না। তবে উচ্চকক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে, সাংবিধানিক সংস্কারের ওপর বিল উত্থাপিত হলে সে বিলের অনুমোদনের জন্য ভোট দেওয়া।
উপরিউক্ত দুর্বলতা বিবেচনায় নিলে এবং পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে উচ্চকক্ষের জন্য নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজতর হবে না। পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের প্রশ্নবোধক ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেয় ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনে বাংলাদেশের উচ্চকক্ষ এমনতর ভূমিকা নিলে তা হিতে বিপরীত হবে—এ ধরনের আশঙ্কা অমূলক নয়।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আগামী ত্রয়োদশ সংসদে মাত্র ১৮০ দিন সময়ের মধ্যে গণভোটে গৃহীত বিষয়াদি–সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেখা গেছে, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বেশি মতপার্থক্য ছিল উচ্চকক্ষ–সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে সংবিধান ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি উচ্চকক্ষের মতো জটিল বিষয়ে ১৮০ দিনের মধ্যে আলোচনা করে ভোট গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এককথায় অসম্ভব। আশঙ্কা হয়, তাড়াহুড়ার কারণে এমন কোনো উচ্চকক্ষের কাঠামো যেন না দাঁড়ায়, যা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা প্রয়োজন। সেটা বর্তমানের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং শক্তিশালী করে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্ভব।
সিপিডি মনে করে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদীয় কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে এবং সংসদীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে, প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের প্রয়োজন হবে না। আশঙ্কা হয়, একটি দুর্বল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রস্তাবিত এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদের চেয়েও দুর্বলতর সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)