চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা সমস্যার সমাধান কোন পথে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটকে শহর থেকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা গত বছরের শেষ দিকে যখন ২২ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, তখন এখানকার নাগরিক সমাজ ও সংস্কৃতিমান মানুষের পূর্ণ সমর্থন ছিল তাদের প্রতি। কারণ, শ্রেণিকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়া থেকে যে ক্ষোভের সূচনা, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও ২১টি দাবি। দাবিগুলোর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অব্যবস্থাপনার এক করুণ চিত্র। যেমন ছাত্রীদের জন্য আবাসনব্যবস্থা তো নেই-ই, শৌচাগারও আছে মাত্র একটি। ছাত্রদের মধ্যেও আবাসনসুবিধা পায় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন। ক্যানটিন নেই, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই নেই ইত্যাদি নানা রকম ‘নেই’–এর মধ্য দিয়ে চলছে চারুকলা ইনস্টিটিউট।

শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ার আগে এসব বিষয়ে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ যেমন ছিল উদাসীন, তেমনি ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীতে অবস্থিত মূল ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনেও পৌঁছায়নি এই শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আবাসিক হল তৈরির প্রয়োজনীয়তার সংশ্লিষ্ট কারও মাথায় না এলেও ঠিকই শহরে শিক্ষকদের ক্লাবের জন্য একটি ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে ইনস্টিটিউটের এ ক্যাম্পাসকেই।

এসব অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা ও বৈষম্যই শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেছে বলা যায়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে তালা লাগিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দফা দাবিতে প্রায় টানা ৮৮ দিন ক্যাম্পাস অচল করে রাখে। এর মধ্যে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষক-কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের অন্য সব দাবি পর্যায়ক্রমে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্যাম্পাস স্থানান্তরের এক দফা দাবি থেকে সরানো যায়নি তাদের।

ইতিহাসের কী অদ্ভুত বাঁকবদল! এতকাল পরে চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্দোলনে নেমেছে এর শিক্ষার্থীরা। অথচ অন্তত ২৫ বছর আগে তেমনি আরেক আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগকে শহরে চারুকলা কলেজের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল। সেটিকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন চট্টগ্রামের শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা। নাগরিক সমাজের পক্ষে চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তত্কালীন সরকারের কাছে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন উৎসবে এসে (১৯৯৯) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি একই ধারার শিক্ষায়তনের পরিপূর্ণ বিকাশের অসুবিধা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন

যত দূর মনে পড়ে, খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদই চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে বিরোধিতা করেছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি দাবি করে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায় শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে যায়নি।

বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ২০১০ সালে চারুকলা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ একীভূত হয়। চট্টগ্রামের বাদশা মিয়া সড়কের মনোরম পাহাড়ি এলাকায় যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, নাট্যকার-নির্দেশক জিয়া হায়দার, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, মনসুরুল করিম ও ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মতো ব্যক্তিরা যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেরা যেমন আলোকপ্রাপ্ত হবেন, সেই আলোয় উদ্ভাসিত হবে নগরের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গন—এ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পেছনে এটিই ছিল স্বপ্ন। এ ছাড়া শহরের ক্যাম্পাসের ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধাও ছিল শিল্পচর্চার জন্য অনুকূল।

দুর্ভাগ্য, আজ এতকাল পরে বলতে হচ্ছে, ইনস্টিটিউটটিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার সেই স্বপ্ন যেমন অধরা থেকে গেছে, তেমনি অবকাঠামোগত সংস্কারও হয়নি নিয়মিত। ফলে আজ যদি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

আন্দোলনের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং পরে খোদ শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ‘যৌক্তিক’ দাবিগুলো পূরণের আশ্বাস দেন। শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো ‘দৃশ্যমান’ উদ্যোগ না দেখায় অষ্টম দিনের মাথায় আবার ইনস্টিটিউটের মূল তোরণে তালা ঝুলিয়েছে। ইনস্টিটিউটকে হাটহাজারীর ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে অনড় থাকে তারা। প্রায় ৮৮ দিন বন্ধ থাকার পর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ায় নবাগত শিক্ষার্থীরা আশান্বিত হয়েছিল। এবার তারা হতাশ হয়ে ক্লাস চালুর দাবিতে মানববন্ধন শুরু করে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিল। এ অবস্থায় ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা ছিল কর্তৃপক্ষের কাছে সবচেয়ে সহজ বিকল্প। কর্তৃপক্ষ সেটা তো করেছেই, উপরন্তু একমাত্র আবাসিক হলে পুলিশি তল্লাশিও চালিয়েছে। এটা সম্ভবত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য কর্তৃপক্ষের একধরনের কড়া বার্তা।

শ্রেণিকক্ষের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ার ঘটনায় ভীত ও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তাদের অনেকগুলো দাবিদাওয়া যে যৌক্তিক, এ কথা আগেই বলেছি। সেই যৌক্তিক দাবিগুলো দ্রুত পূরণ করে ইনস্টিটিউটকে সচল করাটাই এখন প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু পুরো ইনস্টিটিউটকে হাটহাজারীর ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের মতো ব্যয়বহুল উদ্যোগ নেওয়া এ মুহূর্তে অসম্ভব বলেই মনে হয়। এর কিছু আইনি জটিলতাও আছে। তা ছাড়া ইনস্টিটিউটের বর্তমান ২২ জন শিক্ষকের একজনও ক্যাম্পাস স্থানান্তরের পক্ষে নন। মনে রাখতে হবে, শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকেরাও এই প্রতিষ্ঠানের একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত সংস্কারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করে সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক