পাকিস্তানের অর্থনীতি পতনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে

পাকিস্তানের করাচিতে স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রির দোকানের সামনে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে নিহত এক তরুণের স্বজনদের আহাজারি
ছবি : এএফপি

অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে একেবারে অক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে পাকিস্তান। ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তীব্র বন্যা ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে দেশটিতে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহশৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিঃসন্দেহে দুটি ঘটনাই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দেশটিতে কোনো সুসংহত সরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করেছে।

পাকিস্তান একই সঙ্গে কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের অকেজো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নিজেদের স্বার্থে অন্ধ অভিজাত সম্প্রদায়কে এসব সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায় দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুর্বল ও নড়বড়ে রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে রাজপথে ও আদালতে লড়াই করে চলেছেন।

পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টও নতুন এক বিতর্কে জড়িয়েছেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করে। সুপ্রিম কোর্ট তাতে সম্মতি দেন।

২০২২ সালে পাকিস্তান পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের অপসারণ এবং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী যে সহিংসতা ও টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটা রাজনৈতিক সোপ অপেরা বা ধারাবাহিক নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে অংশ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ইমরান খানকে তাঁর লাহোরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ তালগোল পাকিয়ে ফেলে।

মার্চ মাসের মতো এপ্রিল ও মে মাসে সেনাবাহিনীকে সরকার পাশে রাখতে পারলেও– এ দুটি মাস পাকিস্তানের জন্য নিষ্ঠুরতম মাস হতে চলেছে। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কিংবা ইমরান খানকে দিয়ে আরেকটি ভঙ্গুর সরকার গঠনের দিকে এগোতে পারে। অর্থনৈতিক বিপদে পড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও জনগণের সামনে ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই।

২০২৩ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত শুনানি ঝুলিয়ে রেখে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কিছুটা হলেও জিইয়ে রাখেন। কিন্তু ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ঘটনায় ভিন্ন নাটক অব্যাহত থাকায় ইমরান খান কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যান।

এই রাজনৈতিক নাটক যখন মঞ্চায়িত হচ্ছে, সে সময়ে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সংস্কারের শর্তের ব্যাপারে সম্মত না হওয়ায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করেনি আইএমএফ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার এই ঋণ পেলে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্র খুলে যেত পাকিস্তানের।

ইসহাক দার এর আগে বলেছিলেন, চীন ও অন্যান্য দেশ পাকিস্তানকে বেলআউট দশা থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে চায়। ঋণের কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফ নিশ্চিত হতে চায়, ইসহাক দারের অবস্থান আসলে কী? আইএমএফ চায়, পাকিস্তান সরকার ব্যয়ে লাগাম টেনে ধরুক এবং ভালো কর প্রশাসন তৈরি করুক। এ ছাড়া ভতুর্কি বন্ধ এবং বড় শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যাতে রপ্তানিতে কর ছাড় না পায়, সেই শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে গরিবদের জন্য জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু দেশটিতে রাজস্ব ও জ্বালানির যে ঘাটতি, তাতে করে সেটা বাস্তবায়ন অনেকটাই জটিল। ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, আর মার্চ মাসে তা আরও বেড়ে ৩৫ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। ১৯৭৪ সালের পর এই মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ।

খাদ্য কিনতেই মোট আয়ের অর্ধেকটা যাঁদের ব্যয় করতে হয়, তাঁদের জন্য মূল্যস্ফীতি মানে হলো কর দেওয়া
ছবি : এএফপি

খাদ্য কিনতেই মোট আয়ের অর্ধেকটা যাঁদের ব্যয় করতে হয়, তাঁদের জন্য মূল্যস্ফীতি মানে হলো কর দেওয়া। আবার রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হলে আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।

মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ভিত্তি হারিয়েছে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ডলার পাচার উৎসাহিত হচ্ছে। ইসহাক দার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রভাবশালী নওয়াজ শরিফ পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে। অর্থনীতিতে তাঁর ভালো জ্ঞান আছে, তেমনটা নয়। পাকিস্তানে আসার আগে লন্ডনে বসেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, রুপি শক্তিশালী হতে চলেছে।

২০২২ সালের জুন মাসে সাবেক অর্থমন্ত্রী মিফতা ইসমাইল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইসহাক দার সেই উদ্যোগ ধসিয়ে দেন। আইএমএফের সঙ্গে চুক্তিটি আর সম্পাদিত হয়নি। আর ইসহাক দার লন্ডন থেকে পাকিস্তানের মাটিতে পা দিতে না দিতেই ইসমাইলকে বরখাস্ত করা হয়। ইসমাইল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গভর্নর রেজা বাকিরের মেয়াদ (২০২২ সালের মে পর্যন্ত) আর বাড়াননি। ইসমাইলের পদত্যাগ এবং রেজা বাকিরের মেয়াদ না বাড়ানোয় ইসহাক দার পাকিস্তানের অর্থনীতির সম্রাট বনে যান।

পাকিস্তানের অর্থনীতির এই ঘূর্ণাবর্ত ইমরান খানের রাজনৈতিক আন্দোলন চাঙা করে। শহুরে তরুণেরা তাঁর আন্দোলনের প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা ও সৈন্যরা, যাঁরা প্রধানত পাকিস্তানের শহরগুলোয় বেড়ে উঠেছেন, তাঁরাও ইমরান খানের সমর্থক। পাঞ্জাব প্রদেশে ইমরান খানের জোট সরকার এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ইমরানের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গঠিত সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে আরও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে।

সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কিংবা ইমরান খানকে দিয়ে আরেকটি ভঙ্গুর সরকার গঠনের দিকে এগোতে পারে।
ছবি : এএফপি

ইমরান খান আগাম জাতীয় নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন। সরকার থেকে সরানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে প্রথমে তিনি দাবি করেছিলেন। পরে অবশ্য সেই দায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে অব্যাহতি দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান কামরান জাভেদ বাজওয়াকে দায়ী করেন ইমরান খান। এর প্রত্যুত্তরে বাজওয়া বলেন, ইমরান খান ‘বড় মিথ্যুক’।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বর্তমান ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের পেছনে আশ্রয় খুঁজছেন। ইমরান খান তাঁকে পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন। পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য শরিফ চান ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে নিতে।

আরও পড়ুন

কিন্তু রাজপথে যে আন্দোলন চলমান আর মূল্যস্ফীতির কারণে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, তাতে করে শাহবাজ শরিফ তাঁর নড়বড়ে জোট সরকার তত দিন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বড় সন্দেহ থেকেই যায়।

শাহবাজ শরিফের অর্থমন্ত্রী ইসমাইল দার আইএমএফ নিয়ে প্রচুর হম্বিতম্বি করলেন এবং একধরনের ভয়ংকর চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠলেন। এর ফলে তিনি নিজের হাতে তৈরি করা অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে কয়েক মাসের জন্য হারিয়ে গেলেন। এর অর্থ হলো বাস্তবে যখন অন্য দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ আসা দরকার, তখন শাহবাজ শরিফ সরকার একটি আশাবাদী নীতি তৈরিতে ব্যস্ত থাকলেন। ২০২৩ সালের মার্চের শেষভাগের আগপর্যন্ত বিদেশি মুদ্রাপ্রবাহ দৃশ্যমান হয়নি।

এখন পাকিস্তান যদি আইএমএফের ঋণ না পায় এবং সরকার যদি ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়, তাহলে মার্চ মাসের মতো এপ্রিল ও মে মাসে সেনাবাহিনীকে সরকার পাশে রাখতে পারলেও– এ দুটি মাস পাকিস্তানের জন্য নিষ্ঠুরতম মাস হতে চলেছে।

সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কিংবা ইমরান খানকে দিয়ে আরেকটি ভঙ্গুর সরকার গঠনের দিকে এগোতে পারে। অর্থনৈতিক বিপদে পড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও জনগণের সামনে ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই।

সুজা নওয়াজ, রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিশ্লেষক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের ডিস্টিংগুইশড ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে