‘মব ভায়োলেন্স প্রশ্রয় দেওয়া হবে না’, কিন্তু প্রশ্রয় দিচ্ছে কে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে।ছবি: এআই/প্রথম আলো

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরানো এবং লালমনিরহাটে সংখ্যালঘু বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ এনে হেনস্তার ঘটনায় মব ভায়োলেন্সের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যক্তিদের মধ্য থেকেও বক্তব্য এল, কোনো মব ভায়োলেন্স প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কিন্তু ১০ মাস ধরে মব ভায়োলেন্সকে কারা প্রশ্রয় দিল বা প্রশ্রয়ই যদি না দেওয়া হয়, এমন ঘটনা থামছে না কেন? 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও বাড়িঘরের ওপর বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের অংশ হিসেবে শুরুতে এটিকে ‘মব জাস্টিস’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন কয়েক দিন সরকার ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কয়েক সপ্তাহ পরও থানাগুলোয় পুলিশের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু ১০ মাস পরে এসেও কেন ‘মব জাস্টিস’ দেখতে হবে?

শুধু ঢাকায় সংবাদমাধ্যমের সামনে ‘কঠোর হব’, ‘বরদাশত করা হবে না’—এসব বলাই কি মব ঠেকানো যথেষ্ট? সরকারের কেউ কেন শতাধিক মাজার ভাঙচুরের একটি ঘটনাস্থলেও গেলেন না; মবের ঘটনা সাজিয়ে মসজিদের ইমামকে হত্যা করা হলো, তার এতিম মেয়ের কাছে কেউ গেলেন না; কেন মবের হামলার শিকার আহত পুলিশকে কেউ হাসপাতালে দেখতে গেলেন না? 

বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন মানুষ যখন কোনো অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে কোনো ব্যক্তিকে অবমাননা, মারধর, হত্যা বা সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে সাজা দেওয়া বা প্রতিশোধ নিতে যায়, সেটি তখন হয়ে পড়ে মব জাস্টিস। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়।

কারণ, এখানে উচ্ছৃঙ্খল জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ হলে তার রেহাই পাওয়ার সুযোগ বা অপরাধী সাব্যস্ত হলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগের সুযোগ—কোনো কিছুই থাকে না। সামান্য অপরাধে মৃত্যুও ঘটে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও মব জাস্টিস থামানো যায়নি। ফলে সেটি আর মব জাস্টিস থাকেনি, মব ভায়োলেন্সেই রূপ নেয়।

মব ভায়োলেন্স নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে কথিত তৌহিদি জনতা কর্তৃক একের পর এক মাজারে হামলা ও ভাঙচুর; পাশাপাশি ছিল নারীর ওপর হামলা বা হেনস্তার ঘটনাগুলোও। আর আওয়ামী লীগের দোসর তকমা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের ওপর হামলা বা বাড়িঘর, দোকানপাটে ভাঙচুরের ঘটনাও ছিল।

বরগুনার আমতলীতে একটি মাজারে হামলার পর এতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত

পতিত শক্তির কারও বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে সে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু এখানে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার সরকারের ব্যর্থতা বা সরকারের চোখ বুজে থাকা নিয়ে নাগরিক সমাজে সমালোচনা তৈরি হয়।

মব ভায়োলেন্স বন্ধ করতে না পারার পেছনে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তির কাছে জনপ্রিয় হতে চাইছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন।

আবার কিছু প্রশ্নও উঠেছে। যেমন প্রতিটি ঘটনায় যেভাবে মব জাস্টিস, মব ভায়োলেন্সের প্রসঙ্গ আসছে, তা কতটা যুক্তিসংগত? অপরাধকারীদের মব বলে চিহ্নিত করায় এসব ঘটনার বিচার না হওয়ার নিশ্চয়তাও কি তৈরি হচ্ছে না?

সাধারণত সংবাদমাধ্যমগুলোয় ঘটনাভেদে শিরোনামে থাকে ‘হামলা’, ‘মারধর’, ‘ভাঙচুর’, ‘অগ্নিসংযোগ’, ‘সহিংসতা’, ‘গণপিটুনি’, ‘গণধোলাই’, ‘হেনস্তা’—এসব শব্দ। সেসব শব্দের জায়গায় এখন গুরুত্ব পাওয়া শুরু করেছে মব জাস্টিস বা মব ভায়োলেন্স। 

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগের কয়েকটি মাসে চোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তখন সংবাদমাধ্যমে সেসব ‘গণপিটুনি’ই ছিল। ফলে সংবাদ উপস্থাপন বা সংবাদের সম্মতি উৎপাদন বা বয়ান তৈরি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

মূলত সরকার পতনের পর মবের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় ঘটনাগুলোকে চিহ্নিত করার ধরনও পাল্টে গেছে। কিন্তু সব ঘটনাকেই মব জাস্টিস বা মব ভায়োলেন্স বলা যাবে? কারণ এখানে রাজনৈতিক বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জেরে অনেক ঘটনাও ঘটে থাকে বা ঘটছে।

আরেকটি প্রশ্নও উঠেছে, নিজের রাজনৈতিক-মতাদর্শিক-স্বার্থগত বর্গের বাইরের কোনো গোষ্ঠী যখন একটা ঘটনায় যুক্ত থাকে, সেটিকে গড়পড়তায় ‘মব’ বলে আলাদা পরিচয়-রাজনীতিও চলছে কি না? 

আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সহিংস বিক্ষোভকে যখন ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে অবহিত করতে চান, তখন নাগরিক সমাজের কেউ কেউ এ প্রশ্নও তোলেন, তিনি কি মব ভায়োলেন্সকে ন্যায্যতা দিলেন না? কোনো ‘প্রেশার গ্রুপ’ কি সহিংস আচরণ করে? যদিও, বিগত পনের বছরে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন ক্ষোভ প্রকাশ করতে চান তাকে মব না বলে প্রেশার গ্রুপ বলতে চেয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন।

মব ভায়োলেন্স নিয়ে সরকার একের পর এক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। যেমন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না: জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস (১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ প্রথম আলো) ‘মব জাস্টিস’ ঘটলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা: আসিফ নজরুল (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো); ‘মবের মহড়া এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব: উপদেষ্টা মাহফুজ’ (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, প্রথম আলো); ‘মব জাস্টিস’ পরিস্থিতি হলে এখন থেকে কঠোর হব: উপদেষ্টা মাহফুজ’ (৯ মার্চ ২০২৫ প্রথম আলো); ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না: ডিএমপি’ (২০ মে ২০২৫, প্রথম আলো); ‘মব ভায়োলেন্সের’ বিরুদ্ধে কঠোর থাকবে সেনাবাহিনী’ (১৯ জুন ২০২৫, প্রথম আলো); ‘মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা’ (২৩ জুন ২০২৫, প্রথম আলো); ‘কোনো ধরনের মবকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না: ডিএমপি কমিশনার’ (২৪ জুন ২০২৫, প্রথম আলো)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়নাকাণ্ডে অভিযুক্ত নারী হেনস্তাকারীকে মুক্তির দাবিতে চাপ তৈরি করে কথিত তৌহিদি জনতা। পরে জামিনের পর মাথায় পাগড়ি ও গলায় ফুলের মালা পরিয়ে অভিযুক্তকে বরণ করে নেওয়া হয়, যা নাগরিক সমাজকে ক্ষুব্ধ করে। ৬ মার্চ ২০২৫
ছবি: অনলাইন ভিডিও থেকে সংগৃহীত
আরও পড়ুন

এখন এই যে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলা হচ্ছে, সেটি কীভাবে সম্ভব? পুলিশই তো এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না (৬ মাসে পুলিশের ওপর ২২৫ হামলা, মব নিয়ে উদ্বেগ: প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২৫)। থানার ভেতরে ঢুকে পর্যন্ত মব ভায়োলেন্স করার ঘটনা ঘটেছে।

শুধু ঢাকায় সংবাদমাধ্যমের সামনে ‘কঠোর হব’, ‘বরদাশত করা হবে না’—এসব বলাই কি মব ঠেকানো যথেষ্ট? সরকারের কেউ কেন শতাধিক মাজার ভাঙচুরের একটি ঘটনাস্থলেও গেলেন না; মবের ঘটনা সাজিয়ে মসজিদের ইমামকে হত্যা করা হলো, তার এতিম মেয়ের কাছে কেউ গেলেন না; কেন মবের হামলার শিকার আহত পুলিশকে কেউ হাসপাতালে দেখতে গেলেন না? 

স্থানীয় পর্যায়ে উপস্থিত হওয়ার মধ্য দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে দিকনির্দেশনা দিয়ে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকারের যে দৃঢ়তা প্রদর্শন করা যায়, সরকারের সদিচ্ছা বা মনোভাব প্রকাশ করা যায়, সেটি কি ঢাকায় বসে শুধু ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে সম্ভব? এর ফলে মানুষ যদি মনে করে থাকে সরকার নিজেই এই মব ভায়োলেন্সকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা কি অযৌক্তিক হবে?

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

ই–মেইল: [email protected]

[সংশোধনী: এ লেখা প্রকাশের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তাঁর ভ্যারিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। লেখাটিতে তাঁকে নিয়ে উল্লেখ করা অংশটুকু তিনি সেখানে উদ্ধৃত করেছেন। প্রতিবাদলিপিতে তিনি বলেছেন, ‘গত সপ্তাহে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের অভিযোগের বিষয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থিত বক্তারা যেসব বিষয় আলোচনা করেন সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের প্রতি কিছু গোষ্ঠীর বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রসঙ্গটিও ছিল। বিক্ষোভকারী পক্ষকে কেউ কেউ ‘মব’ এবং এ বিক্ষোভকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলে চিহ্নিত করেন। সেমিনারের শেষ বক্তা হিসেবে আমি সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলাম যে এই গোষ্ঠীগুলোকে ‘মব’ বলা কতটা যৌক্তিক নাকি তাদের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলা উচিত? কারণ বিগত শাসনামলে কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারবিরোধীদের এবং জুলাই বিপ্লবীদের সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, তাই এর প্রতিবাদে এখন তাঁদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার বৈধ কারণ রয়েছে। ফলে তাঁদের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত এবং তাঁদের ‘মব’ হিসেবে তকমা দেওয়া তাঁদের প্রতিবাদের অধিকারকে অবৈধ প্রমাণ করার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। আমার মন্তব্য শুধুমাত্র শিকারী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয়ে ছিল। আদালত প্রাঙ্গণে মব ভায়োলেন্সের কোনো ঘটনা, সংখ্যালঘু বা রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের লক্ষ্য করে হামলার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

শফিকুল আলমের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে এই লেখায় তাঁকে উল্লেখ করা প্রসঙ্গটিতে ‘প্রেসার গ্রুপ’ নিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটটি যুক্ত করা হলো। ৩০ জুন ২০২৫, রাত ৯.২৩টায় এ সংশোধন করা হলো। ]