ন্যাটোর কাছে জেলেনস্কি যা চান, সেটা তিনি কখনোই পাবেন না

সদ্যসমাপ্ত ন্যাটো সম্মেলনে জো বাইডেন, ভলোদিমির জেলেনস্কিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ
ছবি : রয়টার্স

গত সপ্তাহে শেষ হওয়া ন্যাটো সম্মেলনের ব্যবচ্ছেদ যদি করা যায়, তাহলে দেখব, ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের যে দূরত্ব ছিল, সেটা কমাতে কেউই তেমন চেষ্টা করেনি। ন্যাটোতে কবে যুক্ত হতে পারবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট সময়সীমা জানতে চেয়েছে ইউক্রেন। পশ্চিমা জোটের নেতারা সময়সীমা নির্দিষ্ট করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আভাস দিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলেই সেটা হতে পারে।

সম্মেলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সব পক্ষই প্রশান্তিদায়ক বক্তব্য দেয়। ন্যাটো নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে নতুন করে অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া সদস্যদেশগুলোর দেওয়া সমর্থন সমন্বয়ের জন্য ন্যাটো একটি ন্যাটো-ইউক্রেন কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সম্মেলনের আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়াকে এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন—এবারের সম্মেলনে পশ্চিম ও কিয়েভের মধ্যে অচলাবস্থার অবসান হচ্ছে। কিন্তু ভিলনিয়াস সম্মেলনের ঠিক আগে ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট না করায় জেলেনস্কি ন্যাটোর বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হন।

ন্যাটোর উদ্দেশে ভলোদিমির জেলেনস্কি লেখেন, ‘এটা অভূতপূর্ব। অদ্ভুত এক সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানোও হচ্ছে না, সদস্যপদও দেওয়া হচ্ছে না। সদস্য হওয়ার জন্য অস্পষ্ট শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।’

এ ভাষ্যের পর জেলেনস্কি এবার ন্যাটোকে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাটুকু সম্পন্ন করেন। সম্মেলন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সম্মেলনের ফল খুব ভালো। আমরা ইউক্রেনের জন্য, আমাদের লোকদের জন্য, শিশুদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নিরাপত্তা বিজয় নিয়ে দেশে ফিরছি।’

এ ভাষ্য থেকে মনে হতে পারে, জেলেনস্কি তাঁর আগের বক্তব্যের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় অনুতপ্ত। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। জেলেনস্কি ভিলনিয়ান থেকে যাওয়ার পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাটোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, কয়েকজন কর্মকর্তা জেলেনস্কিকে তাঁর আচরণের জন্য শাস্তি দিতে চেয়েছেন।

২০০৮ সালে পশ্চিমা সামরিক জোটটির বুখারেস্ট সম্মেলনে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্যপদ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও ছিল অস্পষ্ট একটি প্রতিশ্রুতি। বলা হয়েছিল, ইউক্রেন ও জর্জিয়া ঘটনাক্রমে ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাবে। ইউক্রেনীয়রা ২০০৮ সালের সেই ব্যর্থতা নিয়ে ন্যাটোর সমালোচনা করেন। অনেকে সে সময়ে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজিকে দোষারোপ করেন।

নিবন্ধে বলা হয়, ‘জেলেনস্কির চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়ে ন্যাটোর ভেতরে হতাশার জন্ম হয়েছে—এ ঘটনা তারই প্রতিফলন। এমনকি জেলেনস্কির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকেরাও প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি কি সত্যিই ইউক্রেনের স্বার্থ দেখছেন।’

যুদ্ধ-প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এ ঘটনা কী প্রভাব ফেলবে, সেটা সম্ভবত আগামী মাসগুলোয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের গতি ধীর হয়ে গেছে। পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অপ্রীতিকর এই খেলার চেয়ে ন্যাটো সম্মেলনে যদি ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়ে পরিষ্কার বিবৃতি আসত, তাহলে সেটা নৈতিক বল বাড়াতে সহায়তা করত।

এ গল্পের সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে ন্যাটোর নেতারা জেলেনস্কির অভিযোগের বহর দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তাঁর ভেতরে এই অসন্তোষ কয়েক মাস ধরেই চলে আসছে। এপ্রিল মাসে তিনি ন্যাটোর নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে তাঁর চাহিদা অনুসারে জঙ্গি বিমান ও অগ্রসর প্রযুক্তির বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র না দেওয়ার কারণে।

ইউক্রেন এখন যে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে, সেই অভিযানের জন্য এ ধরনের অস্ত্র অত্যন্ত দরকারি ছিল। এক টেলিভিশন বক্তৃতায় জেলেনস্কি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমের কাছ থেকে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পায়নি। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের শহরগুলোয় আঘাত হানছে, তাদের বোমা আমাদের জনগণ ও শিশুদের ওপর এসে পড়ছে। যাদের সিদ্ধান্তের কারণে এটা ঘটছে, তাদের ওপর ইতিহাসের কালো ছায়া পড়বে।’

ন্যাটোর ভিলনিয়াস সম্মেলনে উন্মুক্ত পর্বে ইউক্রেনের আন্দোলনকর্মী দারিয়া কালেনিউক বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যানকে প্রশ্ন করেন, ‘ফিরে গিয়ে আমার সন্তানকে আমি কী বলব? প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ন্যাটো নেতৃবৃন্দ কেন ন্যাটোতে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানালেন না? তাঁরা কি রাশিয়ার ভয়ে ভীত? রাশিয়া হেরে যাবে, ইউক্রেন জিতে যাবে—এই ভয় কি তাঁরা পাচ্ছেন?’

ইউক্রেনীয়দের এই ভয় সোভিয়েত-উত্তর যুগে তাদের দেশের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কের মধ্যে প্রোথিত। ইউক্রেনে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা প্রায়ই দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার মুখে পড়েছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন আলাদা হওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে দেশটির তখনকার প্রেসিডেন্ট লিওনিদ কুচমা উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের হাতে যে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার ছিল, সেটা ছেড়ে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কুচমা পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার হাতছাড়া করতে চাননি এ কারণে যে তিনি মনে করেছিলেন, এটা তাঁর দেশকে ভবিষ্যতে বড় কোনো শক্তির আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করবে। আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে কুচমা পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারই চেয়েছিলেন, ন্যাটোতে যুক্ত হতে চাননি।

রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন চাননি ইউক্রেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রও পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাসকরণ ইস্যুতে আগ্রহী ছিল এবং চেয়েছিল সাবেক সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত সব কটি দেশ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়াতে সরিয়ে ফেলা হোক। ইউক্রেন ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র ছিল বেলারুশ ও কাজাখস্তানে।

এ বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিণতি পায় কথিত বুদাপেস্ট সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। সদ্য স্বাধীন হওয়া পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ তিনটি দেশের, বিশেষ করে ইউক্রেনের, নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনের উদ্যোগ হিসেবে সমঝোতাটি হয়েছিল।
সমঝোতার সময় রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই তিন রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি করবে না কিংবা বলপ্রয়োগ করবে না।

কিন্তু ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে বরিস ইয়েলৎসিনের স্বাক্ষর করা সেই সমঝোতা স্মারককে বুড়ো আঙুল দেখান পুতিন। এ ঘটনার পর রাশিয়ার কাছ থেকে রক্ষা পেতে ন্যাটোর সদস্য হওয়াকেই নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্ত বলে মনে করে ইউক্রেন। পূর্ব ইউরোপে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এখন ন্যাটোর সদস্য।

২০০৮ সালে পশ্চিমা সামরিক জোটটির বুখারেস্ট সম্মেলনে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্যপদ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও ছিল অস্পষ্ট একটি প্রতিশ্রুতি। বলা হয়েছিল, ইউক্রেন ও জর্জিয়া ঘটনাক্রমে ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাবে। ইউক্রেনীয়রা ২০০৮ সালের সেই ব্যর্থতা নিয়ে ন্যাটোর সমালোচনা করেন। অনেকে সে সময়ে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজিকে দোষারোপ করেন।

ইউক্রেনের সদস্যপদ ঝুলে থাকার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় নেতাদের একমাত্র দায়ী করা যায় না; এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিও গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউক্রেন ইস্যুতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি বারাক ওবামা চাইতেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে।

ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অনাগ্রহ দেখালেও সেটা কখনো পুতিনের ক্ষোভ প্রশমিত করেনি। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সে সময় বলেছিলেন, ‘ইউক্রেন ও জর্জিয়া যাতে ন্যাটোতে যুক্ত হতে না পারে, সে জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা করব।’

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, জেলেনস্কি ও পুতিন দুজনেই ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করবে কি না, সে ব্যাপারে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জেলেনস্কি ভাবেন, ন্যাটো চায় না তাঁর দেশ সেখানে যুক্ত হোক।

  • ড্যানিয়েল উইলিয়ামস ওয়াশিংটন পোস্টের সাবেক কূটনৈতিক প্রতিবেদক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত