বাজেটে কেন খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনো কথা নেই

এবারের বাজেটে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি হচ্ছে ‘খেলাপি ঋণ’, ‘ঋণখেলাপি’ কিংবা ‘মন্দ ঋণ’—এ ধরনের শব্দ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। দেশের ব্যাংকিং খাত যেখানে আস্থাহীনতায় ভুগছে, ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রায় অচল কয়েকটি ব্যাংক, ঋণখেলাপি ও ব্যাংক লুটেরারা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, সে সময় খেলাপি ঋণ নিয়ে এ রকম নীরবতা অবিশ্বাস্য। বাজেট বক্তৃতায় এই রহস্যজনক নীরবতার কারণ কী, তা নিয়ে লিখেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রতিবারের মতো বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। নতুন মেয়াদে সরকার গঠন করার পর বিভিন্ন কারণে এবারের বাজেটের তাৎপর্য ছিল অনেক বেশি। এই বাজেট এমন একটা সময়ে তৈরি করা হয়েছে, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান, নানাবিধ সংকটে ব্যাংকিং খাত ক্ষতবিক্ষত, গভীর খাদে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্যে নেমেছে বিশাল ধস।

মোটা দাগে এই চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মুখোমুখি বাংলাদেশ। কিন্তু সংকট উত্তরণে আস্থা রাখা যায়—এমন কোনো ভরসার কথা বাজেটে নেই। বাজেট বক্তৃতায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে মূল্যস্ফীতির কথা বহুবার বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী স্বীকারও করেছেন, ২০২২ সালের পর এ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নেমে এলেও বাংলাদেশে ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। কেন নামেনি, সে ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে (বহু বিলম্বে) সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের কথা উল্লেখ করে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে বাজেটে। তবে কী উপায়ে (ব্যয়বৃদ্ধিজনিত) মূল্যস্ফীতি কমবে, সে বিষয়ে নেই কোনো পথনির্দেশ। কারণ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ব্যয়বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি নয়।

আগের বছরের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অকপটে স্বীকার করেছিলেন, ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯.৫ শতাংশ থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে না। বর্তমান বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশে গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা অবলুপ্ত করা এবং ঋণের চাহিদা ও তহবিল সরবরাহের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে । তবে এ কাজটি যে যথাসময়ে করা হয়নি এবং সে কারণে তার সুফল যে সহসা মিলবে না, সেটি স্বীকার করা হয়নি।

টাকা-ডলার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ হিসেবে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে বিদেশি রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আশা করা হয়েছে, এতে রিজার্ভ বাড়বে এবং এর ফলে টাকার বিনিময় হার অনুকূল হতে শুরু করবে।

ঋণ ছাড়ের জন্য এই শর্তটি আইএমএফ শিথিল করলেও তাতে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষা করতে হলে এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোরতম অবস্থান নিতে হবে। কোনো প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান মহলকে ছাড় দেওয়ার জন্য দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু আর্থিক খাতকে সংকটাপন্ন করে তোলা দেশ, অর্থনীতি ও সরকারের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না।

বাজেট বক্তৃতার এই পদক্ষেপগুলোর সুফল যদি আদৌ মেলে, তার জন্য বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কমার জন্য সাধারণ মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে হবে কমপক্ষে আরও একটি বছর। তত দিনে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে আরও বহু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, প্রকটতর হবে আর্থিক বৈষম্য।

এখানে উল্লিখিত চারটি সমস্যার তিনটি সম্পর্কে বাজেটে ভাসা ভাসাভাবে একটি আশাবাদী বক্তব্য রাখা হলেও বিশেষ কোনো ভরসার কথা বলা হয়নি। অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি প্রবাসী কর্মীদের ‘প্রেরিত কষ্টার্জিত প্রবাসী আয়’ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও মা-বাবা ছাড়া অন্য কারও কাছে পাঠানো প্রবাসী আয়ের ওপর করারোপ করার সিদ্ধান্ত এই স্বীকৃতিকে অগ্রাহ্য করার শামিল।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেমিট্যান্সের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে উপরোক্ত তিন শ্রেণির বাইরের স্বজনদের মাধ্যমে।

আমাদের রাজস্ব আয় আহরণের দুর্বলতা দূর করার দৃশ্যমান ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই বাজেট বক্তৃতায় স্বীকার করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো সমতুল্য অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ কথা বলা হয়নি, ৪৫ হাজার কোটি ডলার জিডিপির বাংলাদেশে যেখানে কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে, সেখানে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার জিডিপির দেশ নেপালে ২০২১ সালের হিসাবে এই হার ১৭.৫ শতাংশ।

কর কাঠামোতে নতুন করদাতা খুঁজে বের করার পরিবর্তে বিদ্যমান করদাতাদের কাছ থেকে বেশি হারে কর আদায়ের প্রবণতা বন্ধ না হলে রাজস্ব হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না। এতে সৎ করদাতারাও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়ে নিরুৎসাহী হবেন। অপ্রদর্শিত আয়কে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধকরণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

নগদের পরিবর্তে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন উৎসাহিত করার জন্য একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে। এ ব্যবস্থায় ‘পাবলিকলি ট্রেডেড’ নয়, এমন কোম্পানির জন্য পাঁচ লাখ টাকার ওপর একক লেনদেন কিংবা বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার ওপর মোট লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করা হলে আড়াই শতাংশ হারে কর রেয়াতের বিধান রাখা হয়েছে। একক মালিকানাধীন কোম্পানির জন্যও এই শর্তে একই হারে রেয়াত পাওয়া যাবে।

এতে রাজস্ব আয় কম হলেও ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেনের প্রবণতা কমবে বলে আশা করা যায়। তবে ‘পাবলিকলি ট্রেডেড’ কোম্পানির জন্য ১০ শতাংশের কম বা বেশি শেয়ার বাজারে ছাড়ার জন্য যে কর রেয়াত কয়েক বছর ধরে চালু আছে, সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল লাভ হয়নি। তাই এই নতুন ব্যবস্থাটা কতখানি সফল হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ব্যাংকবহির্ভূত লেনদেন যারা করে, কর ফাঁকি এবং অন্যান্য অসংগত কারণেই স্বচ্ছ লেনদেনে তাদের অনীহা দেখা যায়।

রাজস্ব আহরণের ঘনঘটায় সরকারের আয়ের আরেকটি উৎসÑরাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মুনাফার বিষয়টি আমরা সদাবিস্মৃত থাকি। এসবের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করলেও বাকি সবগুলোই বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা করের টাকা দিয়ে তাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে অর্থায়ন করে যাওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ১২টি সংস্থার লোকসান প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ৪৯টি। এসব সংস্থার মধ্যে লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার মুনাফা। অবশ্য তার বিনিময়ে একই সময়কালে এদের পেছনে অনুদান হিসেবে সরকারের গচ্চা গেছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এসব লোকসানি প্রতিষ্ঠান যে শুধু দেশ ও জনগণের বোঝা, তা–ই নয়, তারা ঋণখেলাপিও বটে। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮৪ কোটি টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ অর্থবছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল জিডিপির ১৭ শতাংশ। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে যা মুনাফা এসেছে সেটা জিডিপির একিট নগণ্য অংশ, মাত্র ০.৬ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ থেকে আয় যদি ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে হতো, তাহলে মুনাফা হতো জিডিপির ১.৮ থেকে ২ শতাংশ। ২০২১ সালের হিসাবে এর পরিমাণ হতো ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এসব অদক্ষ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (যে রকম করা হয়েছে চট্টগ্রাম স্টিল মিল এবং আদমজী পাটকলের জায়গায়) স্থাপন করলে আমাদের করের টাকার এমন নয়ছয় হয় না। বিকল্প ব্যবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি খাতে বিক্রি করে দেওয়া উচিত, যাতে সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি বৃদ্ধি পায় রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়।

এবারের বাজেটে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি হচ্ছে ২১৬ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় ‘খেলাপি ঋণ’, ‘ঋণখেলাপি’ কিংবা ‘মন্দ ঋণ’—এ ধরনের শব্দ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। বাংলাদেশের সঙ্গে অপরিচিত কেউ যদি বক্তৃতাটা পড়েন বা শোনেন, তাহলে ধরেই নেবেন আমাদের ব্যাংকিং খাতের কোনোই সমস্যা নেই। অস্তিত্ব নেই ‘ঋণখেলাপি’ নামের কোনো বিশেষ বিষয় বা শ্রেণির।

বিগত বছরের বাজেটে সাবেক অর্থমন্ত্রী অন্তত একবার হলেও ‘খেলাপি ঋণ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি আমাদের আশা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সীমাবদ্ধতা দূর করে ব্যাংক খাতের উন্নয়নে’ সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

সেই ‘অব্যাহত প্রচেষ্টা’র ফলাফল এ বছর বাজেট ঘোষণার দিনই আমরা দেখতে পেয়েছি। খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যার হার মোট ঋণের ১১ শতাংশ। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ, অঘোষিত খেলাপি, অবলোপন করা, বেনামি এবং নানা কায়দায় ঢেকে রাখা ঋণ মিলিয়ে এই পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি।

আরও পড়ুন

দেশের ব্যাংকিং খাত যেখানে আস্থাহীনতায় ভুগছে, ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রায় অচল কয়েকটি ব্যাংক, ঋণখেলাপি ও ব্যাংক লুটেরারা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে,Ñসে সময় খেলাপি ঋণ নিয়ে এ রকম অস্বস্তিকর নীরবতা অবিশ্বাস্য।

বাজেট বক্তৃতায় এই রহস্যজনক নীরবতার একমাত্র কারণ হতে পারে নিয়ন্ত্রণ ও আদায়ে ব্যর্থতার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে ক্ষমতাধর কোনো মহল জড়িত। আইএমএফের ঋণের একাধিক শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানো অন্যতম হলেও শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও ঋণ ছাড় করে যাচ্ছে সংস্থাটি। এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নের চেয়ে তাদের অগ্রাধিকার ঋণ বিতরণ।

 ঋণ ছাড়ের জন্য এই শর্তটি আইএমএফ শিথিল করলেও তাতে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষা করতে হলে এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোরতম অবস্থান নিতে হবে। কোনো প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান মহলকে ছাড় দেওয়ার জন্য দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু আর্থিক খাতকে সংকটাপন্ন করে তোলা দেশ, অর্থনীতি ও সরকারের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না।

  • ফারুক মঈনউদ্দীন ব্যাংকার

  • ই–মেইল: [email protected]