সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া কিংবা আসল দুঃখ ভুলে নকল দুঃখের কান্না

‘ঢাকা শহরে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি বিবাহবিচ্ছেদ’—এটা একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ। কারণ, বিবাহবিচ্ছেদ নানাবিধ কুফলের জন্ম দেয়। প্রথমত, নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে নারী-পুরুষ—উভয়ই কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা হারান। এর একটি বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ছেলেমেয়েদের ওপর। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি লেখাপড়াকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসবই মানবসম্পদের বিরাট অপচয়।

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সঙ্গ লাভের জন্য বিবাহের চেয়ে ভালো কোনো পন্থা নেই। আবার জ্যঁ পল সার্ত্রে, সিমোন দ্য বোভোয়ারের মতো আধুনিক কালের অনেকেই বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসই করেন না। তবে জীবনচক্রের স্বার্থে, আমার ধারণা, অধিকাংশ মানুষই বাট্রান্ড রাসেলের মতকেই গ্রহণ করবেন, অর্থাৎ নারী-পুরুষের সম্পর্কের পরিণতি হবে বিবাহে। বিবাহবিচ্ছেদের আগে ঘটে সম্পর্কের ভাঙন। সে জন্যই সম্পর্ক ভাঙার কারণগুলো আমাদের বোঝা দরকার।

আরও পড়ুন

সম্পর্ক ভাঙার একটা প্রধান কারণ প্রকাশ পেয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়: ‘তোমাকে তোমার ক’রে কখনো ভাবিনি।’ আমরা আমাদের সঙ্গীকে নিজের প্রেক্ষাপটে ফেলে বিচার করি, তাঁর প্রেক্ষাপটে তাঁকে দেখার অভ্যাস আমাদের নেই। বিপত্তিটা তখনই ঘটে। আমার সঙ্গীর জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক শিক্ষা, তাঁর মূল্যবোধ আমার চেয়ে আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। সে জন্য তাঁর প্রেক্ষাপটে তাঁর আচরণ, কর্ম ও বাক্য বিচার করতে হবে। তা না হলে সম্পর্ক টিকবে না; আর টিকলেও তা হবে বিষাদময়।

দুঃখবিলাস একটি ভয়াবহ রোগ। ‘আমার প্রেমিক বা স্বামী আমাকে সময় দেয় না’—এটা একটা সাধারণ অভিযোগ। আমি এক দম্পতিকে চিনি, যেখানে ভদ্রলোক ঢাকা শহরে একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। স্কুলে সারা দিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে শেরাটন হোটেলের লবিতে যেতেন একটি রাজনৈতিক আড্ডায় যোগ দিতে, যেখানে তিনি চা ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। আমি সাক্ষী। রাত ১০টায় বাড়ি ফিরে পরিবারের সঙ্গে ডিনার করতেন। স্ত্রীকে তিনি সবকিছু দিয়েছেন—ফ্ল্যাট, অজস্র গয়না, গাড়ি ও সামাজিক মর্যাদা। স্বল্পশিক্ষিত স্ত্রীকে তিনি করেছেন নিজের প্রতিষ্ঠা করা স্কুলের প্রিন্সিপাল।  কাজের সময়টুকু ছাড়া অন্য সব সময় পরিবারকেই দিতেন। অথচ স্ত্রীকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, ‘আমি আমার বাচ্চাদের সিঙ্গেল মাদার। আমাদের জন্য তাঁর সময় নেই। সে আমাকে ইগনোর করে’ ইত্যাদি।

কোনো কারণ ছাড়া নিজেকে মনে মনে অবহেলিত ভেবে ভেবে ভদ্রমহিলা একসময় অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যান। আমি ভদ্রলোককে কাছ থেকে দেখেছি এবং আবিষ্কার করেছি, একজন দেশপ্রেমিক ভালো মানুষ। তাঁর নৈতিকতার কোনো সমস্যা নেই, টাকাপয়সারও সমস্যা নেই। ওই নারীর দুঃখবিলাসই এই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য দায়ী।

আরও পড়ুন

দুঃখবিলাস আদতে নকল দুঃখ। হুমায়ূন আহমদের ‘নক্ষত্রের রাত’-এ একটি শিক্ষণীয় গল্প আছে। নায়িকা মনীষার বাড়িতে আশ্রিত গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হাসান মনীষাকে জীবনবোধের শিক্ষা দেয়। বলে, ‘প্রেমে প্রতারণার শিকার হওয়ার বা বিয়ে ভেঙে যাওয়ার যে দুঃখ, তা হলো নকল দুঃখ, আর ভাইয়ের মৃত্যু হলো আসল দুঃখ। তুমি নকল দুঃখ নিয়ে আছ। আমি তোমাকে আসল দুঃখের সন্ধান দিয়ে কাঁদাতে চেয়েছিলাম, হালকা করতে চেয়েছিলাম। যাও এবার নতুনভাবে জীবন শুরু করো।’

আমাদের জীবনের ট্র্যাজেডি হলো, আমরা সারা জীবন আসল দুঃখ ভুলে নকল দুঃখে কাঁদি। আসল দুঃখের কয়েকটা উদাহরণ দিই। স্ত্রী বা সন্তান যখন চোখের সামনে স্বামীকে বা বাবাকে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখেন। ক্ষুধার্ত সন্তানদের প্রবোধ দিতে মা যখন পাতিলে জল ফুটান। যুবতী গৃহকর্মী বা পোশাককর্মী ছোট ভাইয়ের স্কুলের মাইনে দিতে অথবা অসুস্থ বাবার ওষুধের জোগান দিতে যখন মনিবের যৌন নির্যাতন মেনে নেন আর আড়ালে চোখের জল ফেলেন। বেকারত্বের জ্বালা সইতে না পেরে বেকার যুবক যখন আত্মহত্যা করেন। যৌতুক মেটাতে না পারায় বিয়ের পিঁড়ি থেকে বরপক্ষ চলে গেলে যখন কনেকে বিয়ের সাজ খুলে ফেলতে হয়। দরিদ্র মানুষের জন্য একটি সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে না পারার কষ্টই আদতে আসল দুঃখ। আসল দুঃখের সন্ধান যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে’। তা–ই যদি হয়, মান-অভিমান, ভুল–বোঝাবুঝি, ব্যক্তিগত চাহিদার অপূর্ণতা তখন হাস্যকর হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

সঙ্গীর কাজের ও কথার ভুল ব্যাখ্যা সম্পর্ক ভাঙার একটা প্রধান কারণ। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তাঁর তত্ত্বে বলেন, সদিচ্ছাই একমাত্র গুণ, যা কোনো স্থান–কাল–পাত্র বিবেচনায় না নিয়েই ভালো হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীকেও কাজ, আচরণ, কথাবার্তা বিবেচনা না করে সঙ্গীটির সদিচ্ছা আছে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। নিজের ভুল খর্ব করতে সঙ্গীর সৎ কাজকেও ভুল হিসেবে দাঁড় করানোর অভ্যাসটা ছাড়তে হবে।

প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর কোনো কথা বা কাজ থেকে ভুল সিদ্ধান্ত টানা সম্পর্ক ভাঙার আরেকটা কারণ। ভুল উপসংহার অন্যের প্রতি অবিচারও বটে। যৌক্তিক সিদ্ধান্ত টানার জন্য কিছুটা বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকতে হয়। অতিরিক্ত আবেগ, অতিরিক্ত অভিমান, অতিরিক্ত রাগ বিশ্লেষণী ক্ষমতা নষ্ট করে। শুধু আবেগনির্ভর সম্পর্ক টেকে না, দরকার মস্তিষ্কের ব্যবহার, দরকার বুদ্ধিমত্তার। আর দরকার একটি মহৎ লক্ষ্য। পৃথিবীতে বহু মানুষ খেতে পায় না, লজ্জা নিবারণের কাপড় পায় না, চিকিৎসা পায় না—তাঁদের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করলে আর ক্ষুদ্র কারণে মান-অভিমান হবে না, অনুযোগ থাকবে না।

সুস্থ যৌনচর্চাকে বলা হয় দাম্পত্য জীবনের সিমেন্ট। যখনই সম্পর্ক খারাপ হয়, একে অপরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। ফলে সম্পর্কের ফাটল বাড়তে থাকে। সে জন্যই বিবাদ-বিসংবাদ যতই হোক না কেন, নিজের ভুল স্বীকার করা, উচ্চবাচ্য করার পর বুকে টেনে ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।

‘টু মিস্টেক নভেলটি ফর প্যারাডাইজ’—এই দার্শনিক তত্ত্ব, অর্থাৎ অভিনবত্বকে স্বর্গ ভেবে ভুল করা মানবজীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। যাঁকে মানুষ হাতে পেয়ে যায়, তাঁকে সস্তা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সন্দীপের অভিনবত্বে বিমলার চোখ ঝলসে ওঠে। প্রেমে পড়ে যায়। পতনও ঘটে। বিমলা যখন উপলব্ধি করে—সন্দীপ একটা লম্পট ছাড়া কিছুই নয়, স্বদেশি আন্দোলন তার একটি ভড়ংমাত্র, তখন তার দেবতুল্য স্বামীর কথা মনে পড়ে। উপলব্ধি করে, তার স্বামীর মতো ভালো মানুষ এ সমাজে দুর্লভ, তখন সে সীমাহীন অপরাধবোধে আত্মহত্যা করতে রওনা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস সবাই পড়েছে, কিন্তু বিমলাদের সংখ্যা কমেনি। কারণ, এটি মানবজীবনেরই একটি নির্মম ট্র্যাজেডি।

আরও পড়ুন

‘স্ত্রীয়াশ্চ চরিত্রম দেবা ন জানন্তি’, অর্থাৎ স্ত্রীচরিত্র দেবতারাও জানেন না—প্রাচীন গ্রন্থের এ বক্তব্য পুরুষবাদী। সত্য হলো, শুধু নারী নয়, পুরুষের চরিত্রও বোঝা দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য, ‘আমরা যেন অশ্রু লবণাক্ত জলে ঘেরা একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। একে অপরের পাড়ে ওঠার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু পারিতেছি না।’ অর্থাৎ মানবের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার তথা মানুষের মনকে বোঝার চেষ্টা বৃথা। সারা জীবন একত্রে বসবাস করেও চেনা শেষ হয় না। সঙ্গী যতটুকু প্রকাশিত হতে চান, ততটুকুই বোঝা সম্ভব। কিন্তু তবু যৌথ জীবন সুখের হতে পারে যদি সততা থাকে, প্রেম থাকে এবং তাঁরা যদি একে অপরের প্রতি একনিষ্ঠ থাকেন।

সম্প্রতি আমার এক বন্ধুর প্রেমের গল্প শুনলাম। এ যেন অভিনবত্বকে স্বর্গ ভেবে ভুল করারই গল্প। তাঁর প্রেমিকা একজন লেখক। তাঁদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই প্রেমিকা একটি বেনামি চিঠি পায়, যেখানে প্রেমিকার লেখার উচ্চ প্রশংসা, ‘আপনার লেখা পড়তে হয় শেষ রাতে নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে, যখন সেতারে ভৈরবি বাজে।’ প্রেমিকা আমার বন্ধুকে জানাচ্ছে, ‘চিঠি পড়ে আমার সমস্ত ক্লান্তি চলে গেছে, রাস্তাঘাট, আকাশ—সবকিছু কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে। একটা অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে।’ আমার বন্ধুটির মনে পড়ে, ‘সে যেদিন প্রপোজ করেছিল, প্রেমিকা ঠিক একই রকম অনুভূতির কথা বলেছিল।’ তার মানে, সে বেনামি চিঠির লেখকের প্রেমে পড়েছে।

আমার বন্ধু একজন একাডেমিক, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, ইংরেজি–বাংলায় অজস্র সুখপাঠ্য হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধ-নিবন্ধের রচয়িতা, মিউজিশিয়ান। প্রেমিকার জন্য সম্ভব সবকিছু করতে সদাপ্রস্তুত। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মন তৃপ্ত হলো না। তাঁর ভালো লাগল ওই আধা পৃষ্ঠার বেনামি চিঠি। এ এক বিষণ্ন ট্র্যাজেডি জীবনের। একজনের প্রতি একনিষ্ঠ হওয়ার অক্ষমতার সমাধান যুক্তির আশ্রয়ে, মানবতাবোধের জাগরণে। বন্ধুর বেদনায় মর্মাহত আমি কাঁচা হাতে নিজেই লিখে ফেলেছি একটি কবিতা—

শহর থেকে ট্রেন আসে।
অরণ্য, পাহাড় আর সমুদ্রপারে
শেষ স্টেশন,
রাত বারোটায় যখন ট্রেন এসে পৌঁছায়
একজন মাত্র যাত্রী থাকে।
লোকটা নেমে আঁকাবাঁকা পথ ধরে
অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
তুমি তাঁর খোঁজে রোজ রোজ বেরিয়ে যাও
জলের মধ্যে ধ্যানস্থ ভগীরথ
তুমি তাঁর কথা জানো না।

  • ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]