একজন বিপ্লবীর উত্থান ও অকালমৃত্যু

৬০ দশকের বিপ্লবী নক্ষত্রপুঞ্জের কেন্দ্রীয় সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রটি ছিলেন নিঃসন্দেহে মো. ফরহাদ
ছবি : সংগৃহীত

কমরেড ফরহাদের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। সুতরাং আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই লেখা কিছুটা দূর থেকে দেখা ও কিছুটা প্রশস্তিমূলক। তাঁকে আমি দেখেছি একজন অত্যন্ত সম্মানিত পার্টিনেতা হিসেবে। পার্টির এক প্রান্তে ছিলেন ১৯৩০ ও ৪০ দশকের সর্বত্যাগী বৃদ্ধ কমিউনিস্ট দাদারা—জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জি, জিতেন ঘোষ, খোকা রায়, মণি সিংহ, হেনাদি, অনিমাদি প্রমুখ নেতা। আরেক প্রান্তে ছিলেন ৬০ দশকের আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষের তরুণ-তরুণীরা—সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মতিউর রহমান, মালেকা বেগম, সর্বকনিষ্ঠ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ নেতা। তাঁরা ছিলেন প্রবহমান ৬০ দশকের স্টোনমিং হেভেনস বা স্বর্গের ঝটিকাবাহিনী। আর এই ৬০ দশকের বিপ্লবী নক্ষত্রপুঞ্জের কেন্দ্রীয় সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রটি ছিলেন নিঃসন্দেহে মো. ফরহাদ। জ্বলজ্বলে এই অর্থে নয় যে তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ‘কেরেসমেটিক’ ব্যক্তিত্ব।  না, তা তিনি ছিলেন না, কিন্তু তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সংগঠকের স্থানটি দখল করে ছিলেন, তা আর কারও পক্ষে দখল করা সম্ভব হয়নি। তিনি ছিলেন আমাদের সর্বত্যাগী প্রবীণ কমিউনিস্ট প্রজন্ম এবং পরবর্তী নবীন প্রজন্মের কমিউনিস্টদের মধ্যে অন্যতম এক ‘সেতুবন্ধ’।

কঠিন জীবন

পাকিস্তানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কমিউনিস্টদের অধিকাংশ সময় থাকতে হয়েছে ‘আন্ডার গ্রাউন্ডে’। কমিউনিস্ট মানেই তখন ছিল ‘আত্মত্যাগ’, জেল-জুলুম-নির্যাতন ও আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ।। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যাঁরাই তখন দীক্ষা নিয়েছেন, তাঁদের জীবনটা সুখের এবং নিরাপদ ছিল না। ১৯৫২ সালে কমরেড ফরহাদের বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর এবং তিনি যখন মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্র, তখনই তার রাজনৈতিক চেতনার সূচনা। এ বিষয়ে তাঁর নিজের স্মৃতিচারণা: ‘লেনিনের বই পড়েছিলাম “কি করিতে হইবে”, নবম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায়।...মোদ্দাকথায় অবশ্য একটা কথা বুঝেছিলাম যে ধনী আর দরিদ্র, শোষক আর শোষিত–এই হল মূল দ্বন্দ্ব। আর শোষণমুক্ত সমাজের নাম হলো “সমাজতন্ত্র”। সমাজতান্ত্রিক মানুষের জীবনের সুখ আর আনন্দের ছবি দেখেছিলাম অনেক বইয়ে, পত্রপত্রিকায়। বিলাত আমেরিকার মানুষের জীবনের ছবিও দেখেছিলাম। সেগুলোও সুন্দর। কিন্তু মন বলতো, সেসব দেশে শান্তি নাই, মানুষের উপর শোষণ আছে সেসব দেশে। কাজেই অল্প বয়সে ভক্ত হয়ে গেলাম সমাজতন্ত্রের। আমার স্কুলের খাতায় আঁকতাম কাস্তে-হাতুড়ির ছবি।’ [মোহাম্মদ ফরহাদ, ‘স্মৃতি থেকে’, মোহাম্মদ ফরহাদ নিবেদিত রচনাগুচ্ছ, ১৯৮৮, পৃ. ১১৩]।

ছোটবেলাতে জেলে যাওয়ার আগেই জেলে যাওয়ার রিহার্সাল শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। মোহাম্মদ ফরহাদ: জীবন ও সংগ্রাম গ্রন্থে গবেষক নিতাই দাস লিখেছেন—‘মো. ফরহাদ শুনেছিলেন যে জেলে গেলে খালি মেঝেতে ঘুমাতে হয় এবং বিছানা-মশারী কিছুই দেওয়া হয় না। ওই কষ্টের জীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনিও তক্তপোষ থেকে বিছানা-মশারি গুটিয়ে নেন। এভাবে খালি তক্তপোষে মশার দংশন সহ্য করে তাঁর অনেক রজনী অতিবাহিত হয়েছিল। একদিন অবশ্য তিনি এই অবস্থায় বাবার কাছে ধরা পড়ে যান।’

ষাট দশকের নক্ষত্র মো. ফরহাদ

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর ছাত্র রাজনীতি প্রথমে কিছুদিন স্তিমিত অবস্থায় থেকে আবার ধীরে ধীরে নানারকম ছদ্মনামের আড়ালে কর্মতৎপর হয়। সে সময় ‘অগ্রগামী’, ‘যাত্রিক’, ‘অগ্রদূত’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি নামের আড়ালে ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগসহ প্রভৃতি সংগঠনের কর্মীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করেন।

সে সময় ছাত্রদের মধ্যে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল খুবই কম। মোহাম্মদ ফরহাদ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালেই পার্টির  সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালের শেষ দিকে ঢাকায় গঠিত হয় মাত্র তিনজন ছাত্র সদস্যকে নিয়ে পার্টির ছাত্র শাখা। এই তিনজন সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ, আব্দুল হালিম এবং আহমেদ জামান। ছাত্রজীবন শেষে আব্দুল হালিম শিক্ষকতায় এবং আহমেদ জামান ডাক্তারি শিক্ষায় নিয়োজিত হন। মো. ফরহাদ ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত থেকে যান পার্টি ও ছাত্র আন্দোলনের গোপন যোগসূত্র হিসেবে। এই সমগ্র সময়টাই তাঁকে আত্মগোপনে থেকে পার্টির পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনকে দিকনির্দেশনা দিতে হয়েছিল। সে সময়কার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমান লিখেছেন, “‘যে পারে সে এমনি পারে, পারে সে ফুল ফুটাতে।’’ মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন অনেকটা তেমনি। হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের মানুষটি। বন্ধুরা “টেক” নাম দিয়েছিল “ছোটলোক” বা “লিটলম্যান”। অনলবর্ষী বক্তাও ছিলেন না তিনি, ছাত্ররাজনীতিতে জনপ্রিয়তার যা একটা বড় উপাদান। তবু তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। সবার নেতা। সবাই জানতো ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতা তিনিই, তাঁর কথাই শেষ কথা।’ [বজলুর রহমান, ‘প্রথম দেখা শেষ দেখা’, মোহাম্মদ ফরহাদ নিবেদিত রচনাগুচ্ছ, জ্ঞান প্রকাশনী, মে, ১৯৮৮, পৃ. ৩০]।

তাঁর অন্যতম সহযাত্রী কমরেড মতিউর রহমান তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছেন, ‘ষাটের দশকের ছাত্র-গণ-আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনায় সরাসরি তদারকি করা, দিনরাত নিয়মিত খোঁজখবর রাখার জন্য কমরেড ফরহাদ বহু সময়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সি-ফাইড, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলের ৩২১ ও নজরুল ইসলাম হলের ৪১ নম্বর রুম এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে মহসিন হলের একটি কক্ষে থেকেছেন। সাহসের সাথে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে কাজ করার ফলেই সে সময়গুলিতে আন্দোলনের উপর পার্টি প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।...এভাবেই দশকের পর দশক ধরে তিনি অব্যাহতভাবে গড়ে তুলেছিলেন পার্টিকে একটু একটু করে। এসব কিছুর সাথে সাথে অস্বাভাবিক রকমের শক্ত ধাতের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়কালে অস্বস্তি ও অসুস্থতায় ভুগতে শুরু করলেন। আর তাই, “বিপ্লবের জন্য আরো পাঁচটি বছর কাজ করে যাওয়ার” অদম্য ইচ্ছেও তাঁর পূরণ হলো না। এ দুঃখ আমরা রাখবো কোথায়?’ [মতিউর রহমান, ‘তাঁর আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা’,  মে ১৯৮৮, পৃ. ১৮]

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও মোহাম্মদ ফরহাদ

ছাত্র ইউনিয়নের বিশিষ্ট সাবেক নেতা সামসুদ্দোহা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের একুশের অনুষ্ঠানে আমি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহূত হই। সে সভার সভাপতি ছিলেন আবুল হাসনাত। তখন আমরা পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতাম। এই সভায়ও এমন একটা বলব এটাই ঠিক ছিল। সভা চলাকালীন হঠাৎ আমি ফরহাদ ভাইয়ের চিঠি পাই। তাতে মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন না বসলে পূর্ববাংলা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে বাধ্য হবে—এই পয়েন্টসের ওপরই মূল গুরুত্ব দিয়ে বক্তৃতা করতে ফরহাদ ভাই পরামর্শ দেন। ...আমি ছাত্র ইউনিয়নের সেই সভায় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করে দিলাম...।’ [স্মৃতিচারণ, সামসুদ্দোহা, ২০.৪.৮৯]

পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদ ফরহাদ এই বিষয়ে বলেন, ‘৭০–এর সাধারণ নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্তের প্রকৃত স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করে ৭১–এর ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের তদানীন্তন নেতা সামসুদ্দোহা স্স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, “ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্তের জবাব হবে স্বাধীন বাংলা কায়েম করা। আমার জানা মতে কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে “স্বাধীন বাংলা” কায়েমের বিষয়ে এ রকম প্রকাশ্য ঘোষণা হিসাবে এটাই ছিল প্রথম ঘোষণা’। [মো. ফরহাদ, ‘দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ যে সংগঠন’, গৌরবের সমাচার, পৃ. ১৪]

সংগঠক কমরেড ফরহাদ

কমরেড ফরহাদের সহকর্মী কমরেড নুরুল ইসলাম কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু দেখেছেন এবং শিখেছেন বলে স্বীকার করে নিয়ে লিখেছেন, ‘পার্টির সদস্য বৃদ্ধি, জনগণের মধ্যে পার্টিকে প্রসারিত করার ধারণা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য সমগ্র পার্টিকে ঐক্যবদ্ধভাবে নামানো সহজ কাজ ছিল না। অতীতের অবস্থার সাথে পার্থক্য উপলব্ধি এবং নতুন অবস্থায় পার্টির প্রসার ঘটানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ভূমিকা ও অবদান পার্টির বিকাশের ধারার সাথে অবিচ্ছেদ্য। আন্দোলনের পটভূমিতে যে হাজার হাজার মানুষ পার্টির পক্ষে সমবেত হচ্ছেন, তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে প্রভাবিত করা এবং কোন ধরনের সাংগঠনিক প্রভাবে আনার জন্য “গণগ্রুপ গঠন” ও “গণক্লাস” চালুর সুস্পষ্ট ধারণা মোহাম্মদ ফরহাদের সৃজনশীল সাংগঠনিক কাজের এক বিশেষ দৃষ্টান্ত।’ [মো. নুরুল ইসলাম, ‘পার্টির সংগঠক মো. ফরহাদ’, প্রাগুক্ত, ১৯৮৮, পৃ. ৮৮]

সৃজনশীল গণ-লাইন ছাড়াও, ‘টেবিল টকেও’ বিরোধী রাজনৈতিক ধারাগুলোর সঙ্গে আলোচনাকালে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন মোহাম্মদ ফরহাদ। অকমিউনিস্টরা অনেকেই সে জন্য তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এমনি একটি লেখায় দৈনিক খবর–এর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান লিখেছেন, ‘বিপ্লবী পুরুষ কমরেড ফরহাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল পাঁচ দফা আন্দোলন ও পনের দলীয় জোট। এখানে “ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর” হিসাবে তার অবদান তুলনাহীন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে “সুষম ভারসাম্য” বজায় রাখার দুরূহ ভূমিকাটি যে বিশাল ব্যক্তিত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি কমরেড ফরহাদ।’[মিজানুর রহমান মিজান, ‘শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখবো’, প্রাগুক্ত, ১৯৮৮, পৃ. ৬০]

বাম-গণতান্ত্রিক সংগ্রামে মোহাম্মদ ফরহাদের যোগ্য উত্তরসূরির সন্ধান আজও অব্যাহত আছে।

  • এম এম আকাশ  অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক