পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ বড় ও মাঝারি অনেক নদ–নদীতে প্রতিবছর ভাঙন হয়। এই ভাঙনের শিকার মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকেন—সরকার তার কোনো খবর রাখে না। গ্রামের পর গ্রাম চোখের সামনে বিলীন হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী কিংবা বিত্তহীন অনেকেই দারিদ্র্যসীমার তলানিতে পড়েন। খাবার নেই, থাকার স্থান নেই, চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই—এসব মানুষের জন্য রাষ্ট্র কখনো মানবিক আচরণ করে না।
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাই নামের একটি বাজারে। এক রেস্তোরাঁর মালিক জানান, ওই বাজারে দুই শতাধিক দোকান আছে। বাজারটি যেখানে ছিল, সেখানে এখন তিস্তা নদী। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জানলাম, বাজারটি ওই স্থানে শুরু হয়েছে ১৯৯৩ সালে। থেতরাই নামের আগের বাজারটি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। ওই বাজারের ব্যবসায়ীরা মিলে নদীভাঙনের স্থান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বাজারটি স্থানান্তর করেন। ওই বাজারে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। তাঁদের অনেকের ভাষ্য, এ বাজারে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধে৵ ৮০–৯০ শতাংশ মানুষ নদীভাঙা।
আমাদের দেশে নদীভাঙনের শিকার লাখ লাখ মানুষের অভিবাসন হয়। গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয় নদীতে। এই নদীভাঙা মানুষ ছড়িয়ে যান সারা দেশে। অনেক বিত্তশালী, যাঁরা সবকিছু হারিয়ে স্থানীয়ভাবে দিনমজুরি করা কিংবা রিকশা চালাতে লজ্জা পান, তাঁরা দূরে চলে যান। অচেনা শহরে-গ্রামে গিয়ে তাঁরা সাধারণ কোনো পেশায় যুক্ত হন।
প্রতিবছর নদীভাঙনে কত মানুষ গৃহহীন হন, এই পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। তবে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর যে নদীভাঙনে গৃহহীন হন, এটি বোঝার জন্য পরিসংখ্যান প্রয়োজন হবে না। নদীভাঙনে অনেক রকম ক্ষতি আছে। পরিবার ভেঙে যায়, এক পরিবারের কয়েক ভাই থাকলে কয়েক স্থানে চলে যান। অনেকে বাড়ি দূরে হওয়ায় বন্ধু হারান। জীবনের তাগিদে বাড়ি ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। স্মৃতি হারানোর বেদনাও কম নয়। অনেকে বাড়িঘর গেলেও আপ্রাণ চেষ্টা করেন মা–বাবা, স্বামী–স্ত্রী ও সন্তানের কবর বাঁচানোর। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকসহ নানা রকম ক্ষতি আছে নদীভাঙনে। নদীর ভাঙনে যাঁদের যাওয়ার কোনো আশ্রয় থাকে না, তাঁরা সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করেন।
ছনের ঘর থাকরেও সেটি একটি ঠিকানা। নদীতে ভেঙে গেলে ঠিকানা চলে যায়। যাঁদের আর্থিক সংগতি আছে, তাঁরা বাড়ি করেন। তাঁরা সাধারণত খুব দূরে যান না। যাঁরা অন্তত জমি ভাড়া নিয়ে হলেও বাড়ি করতে পারেন, তাঁরাও কাছে কোথাও বাড়ি করার চেষ্টা করেন। সামর্থ্যহীনদের অনেকে নদীরক্ষা বাঁধের ওপর বাড়ি করেন। টিনের চালা করে হলেও টিকে থাকার চেষ্টা করেন। একটি ঘর তুলে সেই ঘরে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, ছেলে ও ছেলের বউ একসঙ্গে থাকেন। ঘরের ভেতরে কাপড়ের দেয়াল তুলে রাত কাটান। কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
নদীর পাড়ে বা বাঁধে বাড়ি করার বাইরে একটি বড় অংশের মানুষ আছেন, যাঁরা এসব এলাকায় আর থাকেন না। যাঁরা সাধারণত তুলনামূলক অর্থশালী ছিলেন, বাড়িঘর ভালো ছিল; কিন্তু নতুন করে বাড়ি করার টাকা নেই। কিংবা চাষাবাদের জমি নদীতে বিলীন হওয়ার কারণে নতুন করে অসম্মানজনক (প্রচলিত অর্থে) পেশা বেছে নিতে হবে, তাঁরা আর পরিচিত জনপদে বাড়ি করেন না। তাঁরা দূরের শহরে—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেট, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যান। বাড়ির কেয়ারটেকার হন অনেকে। রিকশাচালক হন কেউ কেউ। বেঁচে থাকার তাগিদে তখন যিনি যে কাজ পান, সেই কাজে নেমে যান।
উল্লিখিত কোনো শ্রেণির মানুষের খবর রাখে না সরকার। সম্প্রতি তিস্তা নদীর ভাঙনের শিকার কয়েক শ মানুষকে নিয়ে একটি জরিপের কাজ আমরা করেছি। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধে৵ যাঁদের বাড়ি নদীতে ভেঙেছে, এমন মানুষদের মধ্যে। নদীভাঙনের শিকার প্রায় সাড়ে ৫০০ মানুষের মধে৵ একজনকে পাইনি, যাঁকে সরকার বাড়ি করে দিয়েছে। কাউকে সরকার ১ শতাংশ জমিও কিনে দেয়নি।
এ বাস্তবতা রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলাতেই দেখেছি। ধারণা করি, সারা দেশের একই চিত্র। তবে এমন যদি হয় রংপুরের নদীভাঙা মানুষদের বাড়ি করে দেওয়া হয় না, অন্য বিভাগের বাড়ি ভেঙে গেলে বাড়ি করে দেওয়া হয়, তাহলেও বুঝব, অন্তত কিছু মানুষ বাড়ি পেয়েছেন।
কোনো সময়ে সরকার নদীভাঙনের শিকার মানুষকে রাষ্ট্রের নাগরিক মনে করতে পারেনি। কারণ, যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁদের কারও এত বড় বিপদে পড়তে হয় না। প্রতিবছর নদীভাঙনে যঁাদের ভিটেবাড়ি বিলীন হয়ে যায়, তাঁদের তালিকা প্রণয়ন করা কি খুব কঠিন কাজ? এমন তালিকা ধরে তো সহজে মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার নদীভাঙনের শিকার মানুষদের গৃহনির্মাণ করে দেওয়ার নীতিমালা এবং তা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত হাজির করতে পারে। এ বছর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, সেটি দিয়ে তারা শুরুটা করতে পারে। সরকার অন্তত যেকোনো একটি কিংবা একাধিক নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে বাড়ি তৈরি করে দিক। তারা কে কোথায় চলে যাচ্ছেন, তা–ও লিপিবদ্ধ থাকুক।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
