তারপর থেকে আমি ঈদের আনন্দঘ্রাণ পাই অন্য মানুষের আনন্দে

বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ও দুই বোন শারমিন আহমদ, মাহজাবিন আহমদের সঙ্গে সিমিন হোসেন রিমি (ডানে)।ছবি : সংগৃহীত

ঈদ অর্থ আনন্দ। রোজা যত শেষ হতে থাকে, চারদিকের সবার মধ্যে মনে হয় আনন্দের ফুলঝুরি ঝরতে থাকে। আমি ছোট শিশু ঈদ খুঁজি সবার আনন্দে। আমার বয়সে বড় আত্মীয়, বন্ধুরা গল্প বলে নতুন কাপড়ের। আম্মা খুব সুন্দর কাপড় সেলাই করতেন। আম্মার সেলাই মেশিনের শব্দ ছিল আমার ঈদের প্রথম আনন্দ। আম্মার যত্ন–ভালোবাসায় আমাদের জন্য অপূর্ব সুন্দর কাপড় তৈরি হলে আদর করে কাপড় ধরে প্রচণ্ড ভালো লাগার একটি অনুভূতি হতো। নতুন কাপড়ের সুগন্ধ সেই অনুভূতিকে আরও গভীর করে দিত।

নতুন কাপড় বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম, একসময় ঘুম ভাঙতেই মনে হতো নতুন দিন। গোসল করে নতুন কাপড় পরে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, এখন কী করব? আম্মা আমাদের দুই বোনকে বলতেন, অতিথি, বন্ধু, বড়দের সবাইকে ঈদ মোবারক বলবে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করবে। আমরা পাঁচ ও সাড়ে ছয় বছরের দুই বোন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে আমাদের বাড়ির আশপাশের বাড়িতে আনন্দ ভাগ করতে যেতাম। সবার বাড়িতে মায়ের পাশাপাশি বাবা থাকেন।

আমাদের বাবা তাজউদ্দীন আহমদ দেশের মানুষকে ভালোবেসে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করার অপরাধে জেলে বন্দী। ঢাকা থেকে অনেক দূরে—ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী। দু–তিন মাসে একবার দেখা হয়। ছোট বোনটির মনে বাবার কোনো স্মৃতি নেই। বাবা যখন বন্দী হলেন, সে তখন মাত্র পাঁচ মাসের শিশু।

যেদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে ময়মনসিংহ কারাগারের উদ্দেশে ঢাকা থেকে রেলগাড়িতে চড়ে রওনা দিতাম, আমার মনে কেমন যেন ঈদ ঈদ একটা ভাব আসত। রেলগাড়ির একটানা কু...ঝিক ঝিক...শব্দ আমার মনকে আকুল করে দিত। রেলগাড়ির জানালার ধারে বসে ঝিকঝিক শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে কতশত শব্দ তৈরি করতাম। মজা লাগত, আমি যতই শব্দ তৈরি করতাম, তার সবই রেলের একটানা সুরের সঙ্গে মিলে যেত। প্রতিবার আমিই হেরে যেতাম।

বছর ঘুরতে সময় লাগে না। ১৯৭১–এ উত্তাল দেশ। পাকিস্তানের আর্মি শাসকদের অত্যাচার আর তাণ্ডবে সারা দেশ বিধ্বস্ত। চলছে মুক্তির লড়াই। মুক্তিযুদ্ধ। হাজার–লক্ষ শরণার্থীর স্রোতে আমরাও ভিনদেশ ভারতে আশ্রিত। সারাক্ষণ শুনতে পাই বাংলাদেশের ভয়ংকর অত্যাচার, হত্যা আর ভয়াবহতার কথা। পাশাপাশি শুনি দেশকে স্বাধীন করার সংকল্পে ভয়হীন মানুষের স্বপ্ন আর লড়াইয়ের কথা।

ছোট একটি রেডিওর তরঙ্গে ভেসে আসা বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমার বয়স তখন আর ৯ বছর থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরিস্থিতি মনকে অনেক বিস্তৃত ও উদার করে দিয়েছে। এমন উত্তাল দিনে রোজার ঈদ বা ঈদুল ফিতর তার নির্দিষ্ট সময়ে এসে পড়ে। এবার আর আনন্দে ভরা উত্তেজনা নেই। নেই আম্মার সেই সেলাই মেশিনের শব্দ। সেই নতুন কাপড়ের আলাদা একটা গন্ধ।

বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, মা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে এক ফ্রেমে লেখকের পুরো পরিবার
ছবি : সংগৃহীত

বাবা তো স্মৃতিতে ভাসেন! তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। বাবার সারাটা দিন কেটেছে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। রেডিও তো আমাদের নিত্যসঙ্গী। সেখানে প্রচারিত হলো বাবার ঈদ শুভেচ্ছা বাণী।

তিনি তাঁর বক্তব্যের শেষ অংশে বলেছিলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিচ্ছি যে যথাসর্বস্বপণ যে স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরা আজ লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তা–ই হোক আমাদের প্রার্থনা।’ (১৮ নভেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত)।

সময় তার সুনির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে চলে। স্বপ্নের মতো স্মৃতিতে ভেসে জীবন থেকে আরও সময় চলে যায়—বছর গড়ায়। ঈদের আনন্দ যখন নির্মল আনন্দে সবে ডানা মেলে জানান দিতে চেষ্টা করে, তখন এসে যায় নির্মম হত্যার বিভীষিকা ১৯৭৫। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদকে সেই ১৫ আগস্ট সকালেই বন্দী করে ফেলে। আবার একটা ঈদ আসে।

এবার আর ময়মনসিংহ কারাগারে নয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। রেলগাড়ির শব্দ নেই। আমার আম্মার সেলাই মেশিনের শব্দ নেই। আমার নতুন শব্দ তৈরির খেলা নেই। এবার মেশিনগানের গুলি আর শব্দে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারজন মানুষের জীবন। যার একজন আমার বাবা। তারপর থেকে আজও আমি ঈদের আনন্দঘ্রাণ পাই অন্য মানুষের আনন্দে। আমার আনন্দ থাকে রেললাইনে, সেলাই মেশিনের শব্দে, আকাশের সীমাহীন বিশালতায়, সব শিশুর মুখের হাসিতে।

ঈদ মোবারক।

  • সিমিন হোসেন রিমি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী