নগরায়ণের বালুর জন্য আর কত নদী হত্যা, গ্রাম ধ্বংস

‘নগরায়ণের কারণে আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বালুর চাহিদা বেড়েই চলেছে।’

যেসব অনিয়মের খবর পড়তে পড়তে আমাদের একরকম অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে, ‘অবৈধ বালু উত্তোলন’ বোধ হয় তার মধ্যে অন্যতম। অথচ নদী ও নদীতীরবর্তী জনপদের জন্য নদী দখল ও দূষণের মতোই বড় বিপদ অবৈধ বালু উত্তোলন। কারণ, অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন স্থাপনা, বসতি ও কৃষিজমি ধ্বংস হয়।

এ বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান পরিচালনা ছাড়া সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয় না। ভাবখানা এমন যে শহুরে মানুষের আবাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য-যোগাযোগের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নদী ও নদীতীরবর্তী জনপদের আবাসন, কৃষি ও অবকাঠামো ধ্বংস খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার!

নগরায়ণের কারণে আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বালুর চাহিদা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ বালুর প্রয়োজন এবং সেই বালুর সংস্থান কোথা থেকে কীভাবে হবে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

সরকারিভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন নদ-নদীর নির্দিষ্ট কিছু জায়গাকে বালুমহাল হিসেবে ঘোষণা করে অর্থের বিনিময়ে ইজারা প্রদান করা হয়। এই বালু উত্তোলনে অনিয়মের দুটি ধরন রয়েছে। একটি হলো বালুমহাল ইজারা নিয়ে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে থেকে বালু উত্তোলন। অন্যটি হলো ইজারা না নিয়েই ইচ্ছেমতো নদী থেকে বালু উত্তোলন। প্রথমে দেখা যাক ইজারার অপব্যবহার কীভাবে ঘটে।

জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বালুমহাল ইজারা প্রদান করে থাকে। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা নিষেধ। তা ছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে নদীতীরে ভাঙনের আশঙ্কা থাকলেও সেখান থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু প্রভাবশালীরা এসব নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করেন না।

আরও পড়ুন

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনা দেখা যাক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মেঘনা নদীর কেদেরখোলা বালুমহালের নির্ধারিত সীমানার ২০০ থেকে ৩০০ ফুট দূরত্বে বালু উত্তোলনের ঘটনা ঘটেছে। ইজারার শর্ত অনুযায়ী, শুধু দিনের বেলা ১০টি খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলার কথা থাকলেও ইজারাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে দিন-রাত সমানতালে ১৫ থেকে ২০টি খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করেছেন। ফলে নদীতীরবর্তী ফসলি জমির ক্ষতিসহ কয়েকটি গ্রাম হুমকির মুখে পড়েছে।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা সদরে ধলেশ্বরী নদী থেকে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বালুমহাল ইজারা নিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করেছেন, সেখান থেকে সরকারি কলেজ, সরকারি খাদ্যগুদাম, হাটবাজার, সেতুসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও কৃষিজমির দূরত্ব মাত্র ৪০০ থেকে ৬০০ গজ। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি খাদ্যগুদাম, শত বছরের পুরোনো হাটবাজার, মহাশ্মশানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হন। শহরের মানুষের জন্য আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের বালুর জোগান দিতে গিয়ে গ্রামীণ মানুষকে গৃহহীন ও ভূমিহীন করার এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জোরে অবৈধ বালু উত্তোলন করে শত শত কোটি টাকা লুণ্ঠনের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বোধ হয় চাঁদপুরের ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান বলে পরিচিত সেলিম খানের ঘটনাটি। জনস্বার্থে নৌপথ সচল করার কথা বলে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে আট বছর ধরে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু তুলেছেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, সেলিম খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বালু তোলার কাজ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত—সাত বছরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অন্তত ১৫টি ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়েছেন। ফলে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে যথেচ্ছভাবে নদী থেকে বালু তোলার কারণে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থান দেবে গেছে, নদীর তীর ভেঙেছে এবং ইলিশের প্রজনন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

আরও পড়ুন

এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। সম্প্রতি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের ‘বাংলাদেশে বালু উত্তোলন মানচিত্র-২০২৩’ শিরোনামে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুসারে, দেশের ৭৭টি নদীর ১৩২টি পয়েন্ট থেকে ২৬৫ ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন, যাঁদের মধ্যে অন্তত ৫৪ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ১৯২ জন প্রভাবশালী, ১২ জন ড্রেজারমালিক-বালু ব্যবসায়ী এবং ৬ জন ব্যবসায়ী। ১৩২টি অবৈধ বালু উত্তোলন কেন্দ্রের মধ্যে পদ্মায় ২০টি, যমুনায় ১৩টি, মেঘনায় ১২টি, ব্রহ্মপুত্রে ৬টি, সুরমা ও পিয়াইনে ৫টি, তিস্তায় ৪টি, সাঙ্গুতে ৩টি ও ইছামতীতে ৩টি কেন্দ্র রয়েছে।

নদ-নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হন। শহরের মানুষের জন্য আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের বালুর জোগান দিতে গিয়ে গ্রামীণ মানুষকে গৃহহীন ও ভূমিহীন করার এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

তবে এ জন্য মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ড্রেজার মেশিন জব্দ করা কিংবা বালু উত্তোলনকারীদের অর্থদণ্ড দেওয়া যথেষ্ট নয়। এ জন্য অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ও তাঁদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। কোনো নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে দেশে বালুর বার্ষিক চাহিদা নির্ণয় করে, সেই অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নদী থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বালু উত্তোলনের স্থান নির্ধারণ করে নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। বালু উত্তোলনের কাজে তদারকির জন্য স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

  • কল্লোল মোস্তফা  বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

    [email protected]