যখন ইফতেখারের কান্না মুছে দিতে পারি না

শহীদ আহনাফ (বামে), শহীদ জাবির (ডানে)

মানসুরা হোসাইন এগিয়ে এলেন। তিনি প্রথম আলোর সংবেদনশীল ও সক্রিয় একজন সাংবাদিক। ‘ওরা আপনার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়।’

কিশোর-কিশোরীরা আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়—এটা খুব বিরল ঘটনা নয়। আমি সানন্দে এগিয়ে গেলাম। তখন, একজন ভদ্রমহিলা, যিনি এদের সঙ্গে এসেছেন, বললেন, ‘এ হলো শহীদ আহনাফের ছোট ভাই।’

এবার আমার থমকে দাঁড়ানোর পালা।

প্রথম আলো আয়োজিত ‘জুলাই-জাগরণ’ নামের বহুমাত্রিক প্রদর্শনী উদ্বোধনের আগেই দেখতে ঢুকেছিলাম। প্রথম আলোর কাগজের পাতাগুলো দেখে খানিকটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তে হলো। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে আমি প্রায় সারাক্ষণই নিউজরুমে থাকতাম। কারফিউ, একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আর অনলাইনে ২৪ ঘণ্টা খবর প্রকাশ করতে হয়, সেটার জন্য সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ চলে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যেমন বিশাল, সারা বাংলাদেশের সব জায়গার মানুষ পথে নেমে এসেছিল, যেমন অসম সাহসিকতার; তেমনি এটা দমনের প্রক্রিয়া ছিল ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় কণ্টকিত, রক্ত, অশ্রু, আর্তনাদ, হাহাকারের প্রকাশ-অসম্ভব একটা মহাসমুদ্র। এই সমুদ্র রক্তে লাল, অশ্রুতে লোনা, হাহাকারে বিদীর্ণ।

আর এত মানুষ শহীদ হয়েছেন, এত হাজার হাজার মানুষ চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, এত মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন যে এটার থই পাওয়া যায় না।

কিন্তু মানুষ তো সংখ্যা নয়। ২৪ জানুয়ারি বিকেলে প্রথম আলোর জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনীর ফটোগুলোর সারি দেখতে দেখতে সেসব দিনে কী কী করছিলাম ভাবছিলাম। ছয় শহীদের ব্যক্তিগত জিনিসপাতির অংশে গিয়ে যখন ঢুকলাম, তখন আমার এত দিনের সাংবাদিকসুলভ চশমাপরা দৃষ্টিভঙ্গি অশ্রুতে ভেসে যেতে লাগল। বীর শহীদ আবু সাঈদের কোট, প্যান্ট, হাতের লেখা কাগজ ইত্যাদি। মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর আইডি কার্ডের লেমিনেশনের ভেতরে তাঁর রক্ত। কলেজছাত্রী নাঈমার মুখখানা যেন মাসুম একটা বাচ্চার। কী সুন্দর ছবি আঁকত সে। তার আঁকা অসমাপ্ত ছবি। মৃত্যুর আগে আঁকা বিপ্লবের পোস্টার। মাহমুদুর রহমান সৈকতের ক্রিকেট ব্যাট, বল। এরপর শহীদ আহনাফ আর জাবির। আহনাফ বিএফ শাহীন স্কুলের ছাত্র। মাত্র ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পেরেছিল সে। মিরপুর ১-এ বাসা। ৩ আগস্ট আন্দোলনে তার মা-ও গিয়েছিলেন সঙ্গে। ৪ আগস্ট তার খালা তাকে তালা দিয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন। আহনাফ বলেছিল, যাচ্ছি না, শুধু নিচ থেকে ঘুরে আসি। চলে যায় ১০ নম্বরের মিছিলে। সেখানেই শহীদ হয় সে। গান করত। অসম্ভব সুন্দর গান করত আহনাফ। তার একটামাত্র ছোট ভাই, ইফতেখার আহমেদ। এবার ক্লাস সেভেনে উঠল।

এই ইফতেখার (১২) এখন তার খালাতো ভাইবোনদের নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমি ওকে আদর করে দিই।

শহীদ আহনাফের ছোট ভাই ইফতেখার
ছবি : প্রথম আলো

মাত্র ৬ বছরের একটা মাসুম বাচ্চা জাবির। ওর চোখের দিকে তাকালে আসমান ভেঙে আসতে চায়। আহারে বাচ্চাটা। ঊরুতে গুলি লেগেছিল ৫ আগস্ট, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন মা-বাবা। ইশ্‌, চিকিৎসা পেলে তো জাবির বাঁচতে পারত! আপনারা এই ফটোটা দেখুন, বলুন, এটা দেখলে পাষাণহৃদয়ও গলবে কি না! ঊরুতে গুলি লেগেছির ৫ আগস্ট, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন মা–বাবা। ইশ্, চিকিৎসা পেলে তো জাবির বাঁচতে পারত! আপনারা এই ফটোটা দেখুন, বলুন, এটা দেখলে পাষাণহৃদয়ও গলবে কি না!

একটু আগে জাবিরের ছবি দেখে কাঁদছিলাম। মাত্র ৬ বছরের একটা মাসুম বাচ্চা। ওর চোখের দিকে তাকালে আসমান ভেঙে আসতে চায়। আহারে বাচ্চাটা।
ছবি : প্রথম আলো

প্রদর্শনী উদ্বোধন হলো ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। আমি আবারও ওই ছয় শহীদের স্মারক প্রদর্শনীর ঘরে ঢুকলাম।

দেখি, শহীদ আহনাফের ছোট ভাই ইফতেখার তার খালা, কাজিনদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের গিটার আর ছবিগুলো দেখছে। এরপর সে কাঁদতে শুরু করল। ওর খালা থামাতে পারেন না। আমরাও পারি না। আমার বুকে মুখ রেখে সে বলে, ও কেন ১০ নম্বরে গেল। না গেলে কী হতো? আমাকে কেন এইখানে আনল? আমি সহ্য করতে পারছি না।

ইফতেখার কাঁদছে তো কাঁদছেই। ওর কান্না থামানোই যায় না। পানি এনে দিই। থামে না। শেষে উপদেষ্টা শারমীন মুর্শিদ আর রিজওয়ানা হাসানকে ডেকে বলি, ওকে একটু সান্ত্বনা দিন।

অন্তত ১ ঘণ্টা ধরে ইফতেখার কেঁদেছে ২৪ জানুয়ারির প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে। কত যে শিশু শহীদ হয়েছে এই আন্দোলনে। কতজন হাত-পা হারিয়েছেন, কতজন হারিয়েছেন দৃষ্টি!

এদের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো পরিস্থিতিকে দেখা হলে আমরা অন্য একটা ছবি পাই।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কোনো বেদনা দেখি না, অপরাধবোধের তো প্রশ্নই আসে না তাঁদের মনে। তাঁরা নিষ্ঠুর প্রতিশোধের কথা বলে যাচ্ছেন।

সম্মানিত পাঠক, এই অবস্থায় আপনার প্রতি অনুরোধ, আপনি শিল্পকলায় যান, জাতীয় চিত্রশালার দোতলায় প্রথম আলো আয়োজিত জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনীতে ঢুকুন। ফটো, ভিডিও—সবকিছু দেখা শেষ করে ছয় শহীদের স্মারক প্রদর্শনীর ঘর দুটোয় যাবেন। আহনাফ, সৈকত আর জাবিরের ব্যবহৃত জিনিসগুলো দেখবেন। সব শেষে দাঁড়াবেন ৬ বছরের শিশু জাবিরের মুখচ্ছবির সামনে। কিছুক্ষণ শুধু ওই নিষ্পাপ শিশুটাকেই দেখবেন।

তখন আপনার মনে আপনাআপনিই এই প্রশ্ন আসবে যে এই শিশুহত্যার পাপের, অপরাধের কি ক্ষমা আছে? বীরের এ রক্তস্রোত মায়ের এ অশ্রুধারা কি ধরার ধুলায় মিলিয়ে যাবে?

আমরা কি এরপরও কিছুই শিখব না? কিছুই করব না? ঘুরে দাঁড়াব না? আমরা কি উন্নত-বৈষম্যহীন সবার মালিকানার একটা সুন্দর দেশ পাব না?

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক