গেল সপ্তাহে নতুন ছয় দেশকে সদস্যপদ দিয়ে ব্রিকস এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিল। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো সৌদি আরব, ইরান, ইথিওপিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা ও মিসর। কিন্তু নতুন সদস্যদের বাইরেও কয়েক ডজন দেশ ব্রিকসে যুক্ত হতে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেকেই মনে করছেন, ব্রিকসের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ জি-সেভেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বে অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে এবং ভূ-অর্থনীতি এখন যুদ্ধের ময়দান। এমন প্রেক্ষাপটে ব্রিকসের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে বৈশ্বিক দক্ষিণ। চীন শুধু ব্রিকসের অংশ নয়, অংশত নেতাও। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারসহ এতগুলো দেশ এই প্রকল্পে অংশ নিতে এবং একে জোরদার করতে চাইছে? অনেকে বলতে চাইছেন, আমরা একটি নতুন শীতল যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হতে চলেছি। এমনকি মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কেউ কেউ এ ধারণার পালে হাওয়া লাগিয়েছেন। কিন্তু আমার মতে, এ ধারণা যথার্থ নয়।
বিজ্ঞজন ও বিশ্লেষকেরা বৈশ্বিক দক্ষিণের উত্থানের আলোচনা করছেন বেশ কিছুদিন ধরে, বিশেষত ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের কাল থেকে। পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে বেশ কিছু দেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ধরে রেখে বৈশ্বিক শক্তির পুনর্বণ্টন ঘটাচ্ছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির ভরকেন্দ্র আশির দশকে ছিল আটলান্টিককেন্দ্রিক, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে। পরে সেটি ৪৮০০ মাইল সরে গিয়ে ২০০৮–এর দিকে তুরস্কের ইজমিরে সরে যায়। ২০৫০–এর দিকে এই ভরকেন্দ্র হয়তো ভারত ও চীনের মধ্যে কোথাও পৌঁছাবে।
নতুন এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর সামনে নতুন বিকল্প হাজির করেছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ কিংবা প্রবল প্রতিযোগিতার সময় কী আচরণ করতে হবে, কী অবস্থান নিতে হবে— তা নিয়ে তারা এখন নতুন করে ভাবার অবকাশ পেয়েছে।
শীতল যুদ্ধের সময় বিশ্বকে মোট তিনটি শিবিরে ভাগ করা হতো, পশ্চিমা ব্লক, সোভিয়েত ব্লক এবং কথিত জোট নিরপেক্ষ ব্লক। শীতল যুদ্ধের পর পশ্চিমা ব্লকে থাকা দেশগুলো একটি নয়া ব্যবস্থার দিকে গেল, যেটিকে তারা বলছে উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা।
নতুন এই একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় পুরোনো প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। ধরে নেওয়া হলো গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ এবং বাণিজ্যিক উদারীকরণ সব শত্রুকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারবে। বিশ্বে নতুন শক্তির উত্থান বলছে যে সেটা হয়নি।
বিশ্বের দূরবর্তী দেশগুলোর ওপর শক্তি খাটানো কিংবা দূরবর্তী অঞ্চলের বন্ধুদের নিরাপত্তা সহযোগিতা দেওয়ার মতো সামরিক শক্তি চীনের নেই। জোটের রাজনীতিতে তাদের ইতিহাস সুখকর নয়। বেইজিংয়ের অংশীদার আছে অনেক, এমনকি কৌশলগত অংশীদারও। কিন্তু তাদের কোনো মিত্র নেই।
ওয়াশিংটন যে বিশ্বব্যবস্থা জারি করেছে, তার প্রতিও বেইজিং আস্থাশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় এই ব্যবস্থার সৃষ্টি। তার কিছু মিত্রও এই ব্যবস্থা থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা পায়। চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র হিংসার বশে এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় তাদের বানানো নীতি অক্ষুণ্ন রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ফোরামে চীনের ভোটদানের ক্ষমতা অর্থনৈতিকভাবে সম অবস্থানে থাকা অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশ কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বব্যাংকে চীনের ভোটের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। চীন ধারাবাহিকভাবে তার নিজের ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ভোটের হিস্যা বাড়ানোর দাবি করে আসছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। বৈশ্বিক দক্ষিণকে চীনের এই উদ্যোগ প্রলুব্ধ করেছে। কারণ, তারা মনে করছে বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান কাঠামোয় তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে, তারা খুব একটা পাত্তাও পায় না।
আরও যে বিষয় আছে তা হলো, ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত হতে হলে শীতল যুদ্ধের মতো কোনো একটি শিবিরের অনুসারী হতে হবে, এমন কোনো প্রতিশ্রুতির বালাই নেই। দ্য সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) ন্যাটোর মতো সামরিক জোট হতে পারে। কিন্তু এখানে অনুচ্ছেদ ৫ নেই। চীন-আমেরিকার সামরিক দ্বন্দ্বের মতো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে চীনের অংশীদারদের সেই বাধ্যবাধকতা নেই।
ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার মানে বেইজিংয়ের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়া যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি দেশগুলো দৃঢ় চিত্তে বলতে চায় তারা জাতীয় স্বার্থে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে চায়।
আল–জাজিরা থেকে, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
● আলী আহমাদী জেনেভা সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির নির্বাহী ফেলো