পাট চাষের অর্থনীতি, বিপাকে কৃষক

গ্রামের মহিলারা ডাঙায় বসে পচা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে দিচ্ছেন কেবল পাটখড়ির বিনিময়ে
ছবি : লেখক

এবার কৃষকেরা পাট নিয়ে যে মহাবিপাকে পড়েছেন, তা নিয়ে কিছু খবর এসেছে। কিন্তু ডিজেল, সার, সেচ, শ্রমিকের মজুরিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, কৃষকের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের সমস্যা নিয়ে ততটা খবরাখবর হয়নি। দেশে ১৩-১৪ লাখ একর জমি থেকে প্রতিবছর ৯-১০ লাখ মেট্রিকটন পাট উৎপাদিত হয়। ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, যশোর, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, বগুড়া পাটের প্রধান এলাকা। এই পাট বিক্রির টাকা দিয়ে কৃষক সংসারের খরচ মেটান, আমন ধানের আবাদ করেন, আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে জমি লিজ বা চুক্তি নেওয়ার টাকা জোগাড় করেন, রবি মৌসুমে আবাদের প্রস্তুতি ইত্যাদি করে থাকেন। এবার সেখানেই টান পড়েছে। সমস্যা বহুমাত্রিক। কাজেই পাটের আলোচনাটা মাঠপর্যায়ের সমস্যার আলোকে করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে কৃষকের পাট চাষের অর্থনীতি নিয়ে কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরা এ লেখার উদ্দেশ্য।

বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে গত এক সপ্তাহে পাট নিয়ে যা দেখছি, তা রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার মতো। প্রথমত, পাট বোনার পর কচি চারা গজাতেই কাটুই পোকার আক্রমণ হয়। বৈশাখ মাসে দিনোটিন কীটনাশক ছিটাতে হয়েছে স্প্রে মেশিন দিয়ে। তাতে খরচ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এবার দীর্ঘ খরা, বৃষ্টিবাদল নেই। খরা পাটগাছের বৃদ্ধির জন্য ভালো হলেও পাট কাটা ও জাগ দেওয়ায় মহাসমস্যা হয়েছে। খাল, বিল, নদী, নালায় পানি নেই। ফরিদপুরের ভাঙ্গা, তালমা, সদর অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, খেত থেকে পাট কাটা হচ্ছে না কেবল জাগ দেওয়ার কোনো জায়গা ও পানি নেই বলে।

অনেক খেতের পাট না কাটায় শুকিয়ে যাচ্ছে। ডোবা, নালা, মজা পুকুর—যে যেখানে পারছেন, কোনোরকমে গাদাগাদি করে পাট ভেজানোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ শ্যালো মেশিন দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উঠিয়ে পুকুর–ডোবা কোনোরকমে ভর্তি করে ওখানেই পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন। অনেকে পুকুরের পালা মাছ আগাম বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে খরচ আরও যাচ্ছে বেড়ে। বিশেষ করে, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় শ্যালো মেশিনে পানি তুলতে বাড়তি খরচ পড়ছে। অনেকে প্রতি বিঘা পাটের জন্য দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে পুকুর ভাড়া নিয়ে পাট পচানোর ব্যবস্থা করছেন।

সব শেষে, আমরা পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি বলে বেশ প্রচার পেয়েছে। এতে নাকি পাটের উন্নত জাত আবিষ্কার, পোকামাকড় দমন, ফলন বৃদ্ধি বা ছত্রাক রোগের প্রতিকার ইত্যাদি সহজ হয়ে যাবে। এতে সরকারের যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার ফিরতি এখনো জানা যায়নি। এদিকে অগ্রগতি কতটুকু, সেদিকেও নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাটের সঙ্গে আমাদের কৃষকদের আত্মিক সম্পর্ক।

তৃতীয়ত, যাঁরা বেশি জমিতে পাট আবাদ করেছেন, তাঁরা নিজের এলাকায় পাট জাগের ব্যবস্থা করতে না পারায় ভ্যানে করে তিন–চার মাইল দূরে কাঁচা পাট বয়ে নিয়ে পদ্মা নদীর খাড়িতে জাগ দিচ্ছেন। আবার পাট পচার পর সেখানেই আঁশ ছাড়িয়ে একইভাবে ভ্যান ভাড়া দিয়ে বাড়িতে বয়ে এনে শুকাচ্ছেন। অমানুষিক কষ্ট, কায়িক শ্রম ও দূরে জাগ দেওয়া পাটের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই। তা ছাড়া গাঁটের পয়সাও বাড়তি খরচ হচ্ছে পাটের কারণে। চতুর্থত, যাঁরা অল্পস্বল্প জমিতে পাট করেছেন, তাঁরা নাহয় বাড়ির আশপাশে ডোবা-নর্দমায় কোনোরকমে পাট জাগ দিয়ে পচিয়েছেন। কিন্তু সেই পচা পাট আবার কৃষাণ কামলা দিয়ে খাল থেকে তুলে আনছেন। তারপর গ্রামের মহিলারা ডাঙায় বসে পচা পাটের আঁশ ছাড়িয়ে দিচ্ছেন কেবল পাটখড়ির বিনিময়ে।

এই ডিভিশন অব লেবারের চিত্র অহরহ রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ছে। মহিলাদের ছাড়ানো পাটের আঁশের বোঝা তারপর ভ্যানে করে নিয়ে যেতে হচ্ছে দূরে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে আনার জন্য। বুঝুন এবার বাড়তি খরচের বহরটা। পঞ্চমত, পাট হচ্ছে ভাসা পানির ফসল। আগে নিয়মিত বর্ষা হতো বলে পাটখেতেই জাগ দেওয়া হতো এবং সেখানেই ভাসা জলে দাঁড়িয়ে পাটের আঁশ ছাড়ানো হতো। এখন পানির অভাবে আলকাতরার মতো পচা জলে গাদাগাদি করে পাট পচানোর ফলে পাটের রং হয়ে যাচ্ছে কালচে। ভূগর্ভস্থ পানিতে ভেজালে এমনিতেই পাটের রং নষ্ট হয়। সোনালি রং আর থাকছে না। ষষ্ঠত, পাটের দাম প্রথমে ভালোই উঠেছিল—সাড়ে তিন থেকে পৌনে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহ থেকে হাটবাজারে পাটের দাম পড়ে গেছে।

পাট চাষের অর্থনীতি এমনিতেই জটিল। বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার তারতম্য, বীজের গুণাগুণ, পোকা ও ছত্রাকের আক্রমণ, তার ওপর পানির অভাবে পাট পচানোর বাড়তি ঝামেলা পাট চাষকে কঠিন ও প্রায় অলাভজনক করে তুলেছে। ফরিদপুর অঞ্চলের ভুক্তভোগী কৃষকদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ ও প্রত্যক্ষ করে দেখেছি, এবার জমি চাষ, বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ, নিড়ানি, টানা–বাছা, পাট কাটা, জাগ দেওয়া, নোয়া ধোয়া, ভ্যানভাড়া, শুকানো—সব মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরি খরচই প্রায় ৮৫ শতাংশ পড়ছে। মোটামুটি হিসাবে দেখা যায়, এক মণ পাট করতে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে বর্তমানে বাজার মূল্য মানভেদে দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। তাহলে কৃষকের কী থাকে? এবার পাটের ফলনও বিঘাপ্রতি ১২ থেকে ১৪ মণের বেশি হবে না। সর্বোচ্চ ১৫ মণ। পাটের ভরা মৌসুম সামনে। দাম কী হবে, তা নিয়ে পাটচাষিরা চিন্তায় পড়েছেন। সোজা হিসাব, শ্রমিকের যে চড়া মজুরি এবং খালবিল যেভাবে শুকিয়ে গেছে, তাতে পাটের দাম প্রতি মণ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা না হলে কৃষক ভবিষ্যতে পাট চাষ করতে নিরুৎসাহিত হবেন।

অনেক খেতের পাট না কাটায় শুকিয়ে যাচ্ছে। ডোবা, নালা, মজা পুকুর—যে যেখানে পারছেন, কোনোরকমে গাদাগাদি করে পাট ভেজানোর চেষ্টা করছেন
ছবি : লেখক

তা হলে উপায় কী? এবার নাহয় ব্যতিক্রমী খরার কারণে পানির অভাবে পাট জাগ দেওয়ার সমস্যা প্রকট হয়েছে। কিন্তু, এখন নিয়মিত বর্ষা–বন্যা হয় না। পাটের জমিতে পলি পড়ে না, খাল–বিলে পানি জমে না। এ অবস্থায় কয়েকটি বিবেচনা সামনে আনা যেতে পারে। প্রথমত, এ বছর পাট পচানোর জন্য নিরুপায় হয়ে ইতিমধ্যে শ্যালো মেশিন দিয়ে যাঁরা পানির ব্যবস্থা করছেন, তাঁদের জন্য ডিজেল ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায়। সেই সঙ্গে এই ভাদ্র মাসেও যাঁরা বৃষ্টির অভাবে মাঠের পর মাঠ সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা রোপণ করছেন, তাঁদের বেলায়ও ডিজেল ভর্তুকি প্রযোজ্য। এমনিতেই আউশ ধান খরায় ভালো হয়নি। এখন আমন লাগাতেই তেল পুড়িয়ে সেচ দিয়ে খেত ভেজাতে হচ্ছে। খরা প্রলম্বিত হলে আমন ফসলও আশানুরূপ না–ও হতে পারে। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকেই বোরো ধান লাগানো শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের ডিজেলসহায়তার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, খাল–বিল ও হাজামজা পুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করা দরকার। এতে পাট জাগের সমস্যা লাঘব হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাট পচানো ময়লা পানি নিষ্কাশন করে ভূগর্ভস্থ পরিষ্কার পানি ভর্তি করে, যেখানে সম্ভব মাছ চাষের ব্যবস্থা হতে পারে। অনেকে করছেনও। তৃতীয়ত, গবেষণার মাধ্যমে পারিবারিক পর্যায়ে ছোট জায়গায় দ্রুত পাট পচানোর কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করা যায় কি না, গবেষকেরা সেদিকেও কাজ করতে পারেন। এটি হলে আমার ধারণা, গ্রামের অনেক তরুণ উদ্যোক্তা জলাধার খনন করে জমানো পানিতে উদ্ভাবনসাপেক্ষ রাসায়নিক দ্রবণ মিশিয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে দ্রুত পাট পচানোর সার্ভিস মার্কেট গড়ে তুলতে এগিয়ে আসবেন। মনে হয়, কৃষকদের জন্য জটিল রিবন রেটিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগের চেয়ে রাসায়নিক সমাধান অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও লাভজনক হবে।

আরও পড়ুন

সব শেষে, আমরা পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি বলে বেশ প্রচার পেয়েছে। এতে নাকি পাটের উন্নত জাত আবিষ্কার, পোকামাকড় দমন, ফলন বৃদ্ধি বা ছত্রাক রোগের প্রতিকার ইত্যাদি সহজ হয়ে যাবে। এতে সরকারের যে বিনিয়োগ হয়েছে, তার ফিরতি এখনো জানা যায়নি। এদিকে অগ্রগতি কতটুকু, সেদিকেও নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাটের সঙ্গে আমাদের কৃষকদের আত্মিক সম্পর্ক। গৃহস্থালি পর্যায়ে পাটের দড়ি অতটা ব্যবহৃত না হলেও পাটখড়ি এখনো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। গ্রামাঞ্চলে পাটকাঠি এখনো রান্নাবান্নার প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘরদোরে বেড়া দেওয়া হয়। পাটকাঠিতে গোবর ঘুটে করে অনেক দরিদ্র মহিলা বেশ উপার্জন করে থাকেন। ইতিমধ্যে পাটকাঠি থেকে চারকল উৎপাদন করার ফ্যাক্টরি হয়েছে। তাই পাট চাষের অর্থনীতিটা ভালো করে বোঝা দরকার।

এম এ সাত্তার মণ্ডল ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের এপিএ পুলের পরামর্শক।