আরব দেশগুলো কেন ফিলিস্তিনের পক্ষে মামলা করতে গেল না

দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আইসিজের সামনে সমাবেশছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার আনা গণহত্যার অভিযোগের শুনানি শেষ হয়েছে। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা সুনির্দিষ্ট করে বলেছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। অচিরেই গণহত্যা বন্ধের জন্য আইসিজেকে আদেশ দেওয়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা আবেদন করেছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, আরব দেশগুলো কেন এই মামলায় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলো না; কেনই-বা তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে আইসিজেতে নালিশ জানাতে গেল না।

আইসিজের সনদ অনুযায়ী, জাতিসংঘের যেকোনো সদস্যদেশ যেকোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এখানে মামলা করতে পারে। সে হিসেবে বলা যায়, আরব দেশগুলো আইসিজেতে সহজেই মামলা করতে পারত। অন্তত গত ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়ের করার আগে প্রিটোরিয়াকে তারা ওই মামলায় বাদী হিসেবে যুক্ত করতে অনুরোধ জানাতে পারত।

গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে যে বিধি ও বাধ্যবাধকতার উল্লেখ রয়েছে, তা অনুসরণের ‘দায়বদ্ধতা’ দক্ষিণ আফ্রিকা স্বীকার করেছে। সেই একই বিবেচনায় ১৯টি আরব ও মুসলিম দেশ জেনেভা কনভেনশনের আওতায় একইভাবে মামলাটি করতে পারত।

এর মধ্যে রয়েছে মিসর, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ইরাক, ওমান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মরক্কো, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ)।

অনেক আরব রাষ্ট্র বলতে পারে, আইসিজেতে মামলা করার মতো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ কেন তারা নিতে পারেনি, সে বিষয়ে তাদের কাছে ‘যুক্তিসংগত’ ব্যাখ্যা রয়েছে। কোনো কোনো দেশ দাবি করতে পারে, তারা দুর্বল অর্থনীতির ছোট দেশ; ফলে এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হতে পারত।

তিউনিসিয়ার মতো কিছু দেশ হয়তো বলবে, তারা এই মামলা করতে পারে না, কেননা তারা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় না। তবে এই সব অজুহাত সৌদি আরব ও মিসরের মতো শক্তিশালী অর্থনীতি ও অধিকতর প্রভাবশালী দেশগুলোর ক্ষেত্রে খাটে না। বরং আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের যাওয়ার যুক্তিসংগত ভিত্তি রয়েছে।

সৌদি আরব ও মিসর এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দিতে পারে তা হলো, ইসরায়েল ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কোপানলে পড়ার ভয়। বেশির ভাগ আরব দেশ বিশ্বাস করে, তাদের পক্ষে ইসরায়েল ইস্যুতে আমেরিকার অবস্থানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

প্রকৃতপক্ষে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি ইসরায়েলের বিরোধিতা করা দূরে থাক, উল্টো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করে গেছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির শর্ত মেনে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিল।

কয়েক বছর ধরে ওপেকের তেল উৎপাদন এবং চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরব ও মিসরের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তথাপি ইসরায়েল ইস্যুতে এই দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রকে চটাতে চায় না। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেলে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে খাদের কিনারায় চলে যাবে।

আরও পড়ুনঃ

ফিলিস্তিনের পক্ষে ভারতে কেন বিক্ষোভ করতে দেওয়া হচ্ছে না

মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন ব্লিঙ্কেন, স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলবেন

এর বাইরে আরব দেশগুলোর মানবাধিকারসংক্রান্ত কুখ্যাত রেকর্ডগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেতে তাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, আইসিজেতে যদি তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করতে যায়, তাহলে ইসরায়েল কিংবা তার মিত্র কোনো দেশও আইসিজেতে আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারে।

সৌদি আরব ও মিসর ছাড়াও বেশির ভাগ আরব দেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা যেতে পারে। মিসর একটি দুর্নীতিগ্রস্ত আইনি ব্যবস্থা দিয়ে বানোয়াট অভিযোগে হাজার হাজার রাজনীতিবিদ এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। মিসরের বিরুদ্ধে বহু মানবাধিকারকর্মীকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার ও গুম করার অভিযোগ আছে। সৌদি আরব একইভাবে অসংখ্য ভিন্নমতাবলম্বীর ওপর উৎপীড়ন চালিয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি আরব যুদ্ধাপরাধ করেছে বলেও জোরালো অভিযোগ আছে।

মূলত নিজেদের এসব অপকর্মের কারণে আরব দেশগুলো আইসিজে কিংবা আইসিসিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নালিশ করতে যায় না।

● ফেরাস আবু হেলাল আরাবি টোয়েন্টিওয়ান নিউজ ওয়েবসাইটের প্রধান সম্পাদক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত