বাহ, আওয়ামী লীগের সমাবেশের জন্য বিশেষ ট্রেন!

রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশ হবে এবং এ জন্য ‘বিশেষ ট্রেনের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে—আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা কি এখন আর গুরুত্ব দিয়ে করার মতো একটি খবর? ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং দেশের রাজনীতির ওপর পূর্ণনিয়ন্ত্রণ কায়েম করা আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সমাবেশ হবে, সেখানে বিশেষ বিশেষ অনেক কিছু হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু আমাদের, মানে সাংবাদিকদের সমস্যা হচ্ছে ‘স্বাভাবিক’ বিষয়কে আমরা যেন অনেক সময় স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারি না। তাই এসব নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করি, দলীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় ট্রেন ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্নও তুলি!

একটি বিভাগীয় সমাবেশ করতে অনেক প্রস্তুতি লাগে। নাটোরে তেমনই এক প্রস্তুতি সভায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ঘোষণা করেছেন, রাজশাহীর সমাবেশে কর্মীদের নিয়ে যেতে নাটোর থেকে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ ট্রেনটি কোথায় কোথায় থামবে, সেই জরুরি তথ্যও তিনি দলের কর্মীদের দিয়েছেন। ‘বেলা একটায় নাটোরের মাধনগর থেকে ছেড়ে নলডাঙ্গা, বাসুদেবপুর, নাটোর এবং ইয়াছিনপুরে পাঁচটি স্টেশনে থামবে। যাতে ৮ থেকে ১০ হাজার নেতা–কর্মী বহন করতে পারবে। এর বাইরে আরও প্রায় ৩০ হাজার নেতা–কর্মী বাস এবং ট্রাকে করে অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।’

আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সমাবেশের জন্য রেলমন্ত্রীর কাছে বিশেষ ট্রেন চেয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী তা পেয়েছেন। সব দলের জন্যই কি বিষয়টি এত সহজ? ভাড়া দিলেই কি বিশেষ ট্রেন পাওয়া যায়?

আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী সজ্জন মানুষ। দলীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় ট্রেন ব্যবহার নিয়ে টেলিফোন করে প্রশ্ন করা হলে অন্য অনেকের মতো ফোন রেখে দেননি বা খেপেও যাননি। বরং বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন; ‘আমরা ভাড়া নিচ্ছি। এগুলো চট্টগ্রামে বেশ কিছু বগি, যেগুলো মেরামত করে কেবল তৈরি হয়েছে। কোনো ট্রেনের কোনো শিডিউল ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমরা টাকা দিয়ে ট্রেন ভাড়া করেছি। এই বিশেষ ট্রেনটা চলবে আমরা টিকিট কেটে যাব এবং কোনো স্বাভাবিক ট্রেনের শিডিউলের যাতে ব্যাঘাত না হয়, কারও যাতে ক্ষতি না হয়। কারণ, আমরা যদি রূপসা পুরোটাই বুক করে ফেলি টিকিট, তাহলে তো সাধারণ যাত্রীরা রূপসাতে ঢুকতেই পারবেন না। তাঁদের তো যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটবে। এই কথা বিবেচনা করেই আমরা রেলমন্ত্রীর কাছ থেকে এই বিশেষ ট্রেনটা ভাড়া করেছি।’

প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে আমরা আরও বুঝতে পারি, তিনি শুধু সজ্জনই নন, আইন, নৈতিকতা ও জনস্বার্থের ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন। কারণ, ট্রেনটি ভাড়া দিয়ে নেওয়া হচ্ছে, এখানে অনিয়মের কিছু নেই। শিডিউল ট্রেনের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে এই বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন যে চাইলে তিনি বা তাঁর দল রাজশাহীমুখী রূপসা ট্রেনের সব টিকিট বুক করে ফেলতে পারেন এবং তেমন কিছু করা হলে সাধারণ জনগণ সেই ট্রেনে ঢুকতেই পারত না, এতে জনগণ দুর্ভোগে পড়ত। তাই সে পথে না গিয়ে ‘বিশেষ ট্রেনের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানে আইন মেনে ও জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই সব করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

একজন সাংবাদিক হিসেবে এখন আমার মনে হয়, আমরা সম্ভবত দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা ভুলে যাই বা মনে রাখতে চাই না। তা না হলে আমরা কেন একজন প্রতিমন্ত্রীকে এসব প্রশ্ন করতে যাই! আইসিটি প্রতিমন্ত্রী একজন সজ্জন মানুষ বলে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি না–ও দিতে পারতেন। তাতে তাঁর ক্ষতি-বৃদ্ধি কিছুই হতো না। আমরা কেন জানি বুঝতে চাই না যে সরকারি দল চাইলে এ দেশে এখন সবকিছুই করতে পারে! একটি ‘বিশেষ ট্রেন’ তো নস্যি।

আসলে সমস্যাটা আমাদের নিজেদেরই। ওই যে বলেছি, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আমরা সাংবাদিকেরা কেন জানি বিবেচনায় নিতে চাই না! আমাদের মনে খালি বেয়াড়া প্রশ্ন জাগে। যেমন এত কিছু বলার পরও আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর একটি প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে, পাঠকদের সামনে তোলার লোভ সামলাতে পারছি না! আওয়ামী লীগের বিভাগীয় সমাবেশের জন্য রেলমন্ত্রীর কাছে বিশেষ ট্রেন চেয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী তা পেয়েছেন। সব দলের জন্যই কি বিষয়টি এত সহজ? ভাড়া দিলেই কি বিশেষ ট্রেন পাওয়া যায়?

গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ১০টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। সেই সমাবেশগুলোর আগে কী কী হয়েছিল, তা কি পাঠকদের মনে আছে?

আবারও বোকার মতো প্রশ্ন করলাম। বিএনপির সমাবেশগুলোর আগে যা হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বাভাবিক! আর ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের সমাবেশের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা আরও বেশি স্বাভাবিক!

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]