ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে হুমকি বাড়ানোকে সহজেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খামখেয়ালি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এতটাই বড় সংঘাতের সঙ্গে জড়িত যে একে সীমিত প্রভাবের আঞ্চলিক ঘটনা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। ইউক্রেনের মতোই ভেনেজুয়েলা এখন বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হয়ে উঠছে। এর মানে এই নয় যে বিশ্ব নিশ্চিতভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। যদিও সেই আশঙ্কা সব সময়ই থাকে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রধান দুই চরিত্র ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন এখন সংঘাতের চেয়ে পারস্পরিক লাভজনক লেনদেনের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। তাই বৈশ্বিক যুদ্ধের চেয়ে বৈশ্বিক সমঝোতার সম্ভাবনাই এখন বেশি মনে হয়।
ভেনেজুয়েলা কোনো বড় শক্তি নয়। তবু দেশটি বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের মজুত রয়েছে। একই সঙ্গে দেশটি চীন, ইরান ও রাশিয়ার রাজনৈতিক মিত্র। এই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। এই তিন দেশের মধ্যে ভেনেজুয়েলা প্রশ্নে সবচেয়ে জটিল অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ক্রেমলিনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। তবে এর মধ্যেই কিছু সম্ভাব্য লাভও আছে। ২০২৫ সালের শুরুতে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরতেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের পরিস্থিতি হঠাৎ একধরনের অংশীদারত্বে ফিরে যায়।
রাশিয়ার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি হবে, যদি যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ভেনেজুয়েলায় জড়িয়ে পড়ে। তবে মাদুরো দ্রুত ক্ষমতা হারালেও সেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। সবকিছু স্থির হওয়ার পর পরিস্থিতি হয়তো একধরনের লেনদেনের মতো দেখাবে। যেমন রাশিয়ার শর্তে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী একটি ভেনেজুয়েলা।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। তারা প্রায় নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। তবে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া চালু রাখে। জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সর্বশেষ সংস্করণে যুক্তরাষ্ট্র ‘সরাসরি হুমকি’ তালিকা থেকে রাশিয়ার নামও বাদ দেয়। ট্রাম্পের উদ্যোগে ইউক্রেন নিয়ে শান্তি আলোচনা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পুতিনের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে যুদ্ধটি তাঁর শর্তেই শেষের দিকে যাচ্ছে।
এই সবকিছু বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, ভেনেজুয়েলার মতো দূরের এবং রাশিয়ার মূল স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কহীন বিষয় নিয়ে ক্রেমলিন এখন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে না । রাশিয়া কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ লাতিন আমেরিকান সরকারকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠবে না। ভেনেজুয়েলার প্রতি রাশিয়ার সমর্থন সব সময়ই ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর কতটা চাপ দিচ্ছে, তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত থাকবে।
নিকোলাস মাদুরোর সরকারের সম্ভাব্য পতন ক্রেমলিনের জন্য পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শাসন পরিবর্তনের নেশার কারণে যেসব দেশে রাশিয়ার ঐতিহ্যগত মিত্ররা ক্ষমতা হারিয়েছে, সেখানে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রাশিয়ার আছে। এখানে একটি নির্দয় রাজনৈতিক হিসেবেও কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেনেজুয়েলায় সামরিক হামলা চালায়, তাহলে সেই পদক্ষেপ থেকে পাওয়া ভূরাজনৈতিক লাভ সম্ভাব্য ক্ষতির চেয়েও বেশি হতে পারে রাশিয়ার। কারণ, এতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রশ্নে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র নৈতিকভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের ‘নিজস্ব উঠানে’ সামরিক শক্তি দিয়ে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারে, তাহলে রাশিয়া কেন নিজের অঞ্চলে একই কাজ করতে পারবে না?
সাধারণভাবে রাশিয়ানরা নিজেদের পুরোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে দেখে। তারা নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিতে চূড়ান্ত রক্ষণশীল মনে করে। তাদের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব একটি সংশোধনবাদী শক্তি, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার জন্য দায়ী। ইউক্রেন যুদ্ধকে তারা সেই সংশোধনবাদ ঠেকানোর একটি উপায় হিসেবে দেখে। তবে তাদের যুক্তি হলো যদি পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই না থাকে, আর তার জন্য পশ্চিমাই দায়ী হয়, তাহলে নতুন একটি ব্যবস্থার জন্য দর–কষাকষি করা যাক।
এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিম গোলার্ধে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবে, আর রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলগুলোতে নিজের প্রভাব বজায় রাখবে। রাশিয়ার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি হবে, যদি যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ভেনেজুয়েলায় জড়িয়ে পড়ে। তবে মাদুরো দ্রুত ক্ষমতা হারালেও সেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। সবকিছু স্থির হওয়ার পর পরিস্থিতি হয়তো একধরনের লেনদেনের মতো দেখাবে। যেমন রাশিয়ার শর্তে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী একটি ভেনেজুয়েলা।
লিওনিদ রাগোজিন রিগাভিত্তিক একজন সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তারে অনূদিত